সারাদেশ
এন্ডোস্কপি করাতে গিয়ে যুবকের মৃত্যু: যা বলছেন চিকিৎসক
রাজধানীর ধানমন্ডির বেসরকারি ল্যাব এইড হাসপাতালে পেটে গ্যাসজনিত সমস্যার কারণে এন্ডোস্কপি করাতে গিয়ে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে রাহিব রেজা নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। তিনি রাজধানীর একটি আইটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। স্বজনদের অভিযোগ, ল্যাব এইড হাসপাতালে পরীক্ষার রিপোর্ট না দেখেই রাহিব রেজাকে অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করা হয়। শারীরিক জটিলতার মধ্যেই এন্ডোস্কপি করা হয়। যে কারণে তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় এবং একপর্যায়ে শারীরিক অবস্থা আরও জটিল হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তবে চিকিৎসক বলছেন, রোগীর আগে থেকে থাকা শারীরিক জটিলতা সম্পর্কে তাকে কিছুই জানানো হয়নি।
স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রোগীকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এন্ডোস্কপি করার জন্য পরামর্শ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা বিভাগীয় প্রধান ও হেপাটোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল। তার পরামর্শ মতো সেদিন সন্ধ্যায় রাহিব ধানমন্ডির ল্যাব এইড হাসপাতালের বহির্বিভাগে অপেক্ষা করেন। রাত আনুমানিক ১১টার দিকে তার পরীক্ষা শুরু হয়। প্রায় দেড়ঘণ্টা পর রোগীকে তারা মুমূর্ষু অবস্থায় দেখতে পান। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে ল্যাব এইডের আইসিইউতে নেওয়া হয়। তিন দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর তাকে সোমবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) সকালে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।
গত শুক্রবার ফেসবুক ইনফ্লুয়েন্সার রাফসান তার ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, ল্যাব এইড হাসপাতালে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাহিব ‘সম্ভবত’ চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসার কারণে এখন ‘মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা’ লড়ছেন। তাকে এই মুহূর্তে ফুল-অন লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। ল্যাব এইড হাসপাতালকে এর জবাব দিতে হবে।
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীলের বক্তব্য
ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘রোগীর সমস্যা ছিল, তিনি আমার কাছে ‘ফ্যাটি লিভার’ নিয়ে এসেছিলেন। আমি তাকে এন্ডোস্কপি করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। আমি যখন এন্ডোস্কপি পরামর্শ দেই তখন দুভাবে করার অপশন দেই। এক হচ্ছে ঘুম পাড়িয়ে করবেন না, জেগে থেকে করবেন। সাধারণত মানুষ ঘুম পাড়িয়ে করতে রাজি হয়। যারা একটু স্বাস্থ্যবান তাদের ঘুম না পাড়িয়ে করা কষ্টকর। কারণ তারা টিউব সহ্য করতে পারে না। এসব কথা বলার পর রোগী রাজি হন ঘুম পাড়িয়ে করার জন্য। আমরা সম্মতি নিয়ে সেদিন ঘুম পাড়ালাম। ঘুম পাড়ানোর সময় আমরা কোনও এনেস্থেসিয়া ব্যবহার করি না। আমরা ঘুমের ওষুধ দেই। ল্যাব এইডে আমরা যখন ঘুম পাড়াই তখন রোগীর সঙ্গে অক্সিজেন এবং মনিটর থাকে। আমার এন্ডোস্কপি করতে এক মিনিটও সময় লাগেনি। কিছু নরমাল পর্যবেক্ষণ ছিল এবং স্যাচুরেশন ভালো ছিল। যেই টেবিলে করে রোগীকে এন্ডোস্কপি করতে আনা হয়, সেই টেবিলেই আমরা রোগীকে অবজারভেশন রুমে পাঠিয়ে দেই।
এন্ডোস্কপি করার পরের অবস্থার কথা তুলে ধরে অধ্যাপক মামুন আল মাহতাব বলেন, ‘সেখানে পাঠানোর পর কর্তব্যরত নার্স মনিটর লাগানোর পর আমাদের জানালো রোগীর অবস্থা খারাপ। আমি ছাড়াও সেখানে দুজন চিকিৎসক এবং তিন জন নার্সসহ সাত থেকে আট জন সবসময় আমার টিমে থাকে মনিটর করার জন্য। আমরা সেখানে ছুটে গেলাম, রোগীকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম, যা যা ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার ছিল তা নিলাম। কিছুক্ষণ পর দেখলাম রোগীর স্যাচুরেশন ফিরে এলো, ব্লাডপ্রেসার পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু জ্ঞান ফিরে আসেনি। এর মধ্যে আবার প্রেসার আর অক্সিজেন স্যাচুরেশন ড্রপ করে। তখন আমি রোগীর পরিবারের খোঁজ করলাম। তখন রোগীর সঙ্গে একজন অ্যাটেন্ডেন্ট পেলাম। উনি আমাকে রোগীর পার্টনার ও কলিগ পরিচয় দিলেন। রোগীর বিষয়ে তাকে জানালে তিনি জানান—বাসায় রোগীর বোনের সঙ্গে কথা বলতে হবে। আমি বললাম—আপনি বাসায় যোগাযোগ করেন কিন্তু রোগীর অবস্থা খারাপ হচ্ছে, আমরা আইসিইউতে নিচ্ছি। আমরা অক্সিজেন সাপোর্ট দিয়ে রোগীকে আইসিইউতে নিলাম। সেখানে দেখলাম তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে।
আইসিইউতে রোগীর স্যাচুরেশন, পালস কিছুই পাওয়া যাচ্ছিল না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তখন আমরা রোগীকে ভেন্টিলেটরে (লাইফ সাপোর্ট) দিলাম। আমি সেদিন রাত ২টায় রোগীকে দেখে বেরিয়েছি। ভোরে আমার চেম্বার শেষ করে আবারও রোগী দেখে বেরিয়েছি। আমি একদিনের জন্য দিনাজপুরে গিয়েছিলাম। যদিও আমার আরও একদিন পর ফেরার কথা ছিল, আমি টিকিট চেঞ্জ করে রাতে ফিরে এসে রোগী দেখেছি। সেদিন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সোহরাব উজ জামান, কিডনি বিশেষজ্ঞ ডা. মনিরুজ্জামান, আইসিইউ ইনচার্জ ডা. ফারুক, নিউরো মেডিসিনের অধ্যাপক আশরাফ আলী, মেডিসিনের অধ্যাপক গালীব এবং বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. সাইদুল ইসলাম রোগীকে দেখেছেন। রোগীর পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন, রোগীর পরিস্থিতি সম্পর্কে জানিয়েছেন। কোনও কিছু গোপন রাখা হয়নি। রোগীর পরিবার মেডিক্যাল বোর্ড চেয়েছেন, শনিবার আমি মেডিক্যাল বোর্ড করার জন্য বলেছি। শনিবার দুপুরে মেডিক্যাল বোর্ডের সভায় আমি ছিলাম। সেখানে রোগীর পরিবারকে সব কিছু জানানো হয়েছে। তারা সবকিছু বুঝেছেন। রোগীর একজন আত্মীয় মকবুল সাহেব তিনি বোর্ড সভার পর আমাকে জানিয়েছিলেন–‘আমাদের কোনও ব্যবহারে যদি কষ্ট পেয়ে থাকেন আমরা খুবই দুঃখিত, শুধু নিশ্চিত করেন যাতে রোগীর ক্ষেত্রে চেষ্টার যেন কমতি না হয়। আমরা আপনাদের চেষ্টায় সন্তুষ্ট আছি।‘
রবিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) সকালে রোগীর ব্রেন ডেড হয়। এ সময় ‘ক্লিনিক্যালি ডেথের’ কথা রোগীর পরিবারকে ডেকে জানানো হয়েছে উল্লেখ করে ডা. মামুন আল মাহতাব বলেন, ‘তাদের বলেছি, আপনারা চাইলে মেশিনে রাখতে পারেন আবার খুলেও ফেলতে পারেন। রোগীর মা আমাদের জানালেন– মিরাকল হলেও হতে পারে, আমরা মেশিন অব্যাহত রাখবো। গতকাল সোমবার সকালে রোগীর অর্গান ফেইল করলো।’
পরে রোগীর কিছু হিস্ট্রি নেওয়া হয়েছে বলে জানান এই চিকিৎসক। তিনি বলেন, ‘জানতে পারলাম, রোগীর স্লিপ অ্যাপনিয়া বা ঘুমের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার রোগ ছিল আগে থেকেই। রোগীর সেপ্টিসেমিয়া (ফুসফুসের সংক্রমণ রক্ত প্রবেশ) ছিল, যেটা শরীরের কোনও একটা ইনফেকশনের কারণে হয়েছে। এসব কোনও তথ্য আমাদের দেওয়া হয়নি। ব্লাড কাউন্ট বেশি ছিল, সম্ভবত ফুসফুসের ইনফেকশন থেকে; এটিও আমাদের জানানো হয়নি। ডায়াবেটিসের কারণে অনেক সময় ইনফেকশন বোঝা যায় না, হয়তো এজন্য আমাদের বলেননি। এর জন্য আমি রোগীকে কোনও দোষারোপ করি না। হয়তো তিনি বোঝেননি যে এগুলো বলার প্রয়োজন ছিল। স্লিপ অ্যাপনিয়া পরীক্ষা করতে হলে একজন মানুষকে এক রাত হাসপাতালে ঘুমাতে হয় মেশিন লাগিয়ে।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে নিজের ২০ বছরের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখানে আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।’