বরিশাল
নদী ভাঙনের ঝুঁকিতে বরিশালের ৮০টিরও বেশি স্থান, আতঙ্কে বাসিন্দারা
বরিশাল সদর উপজেলার শায়েস্তাবাদ ইউনিয়নের দক্ষিণ আইচা গ্রামের প্রায় ৫০০ মিটার সড়ক আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। এই স্থানে ভাঙন নতুন কিছু নয়। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, প্রতি বছরই ভাঙছে গ্রামটি।
ওই গ্রামের কৃষক বারেক মুন্সী বলেন, সপ্তাহখানেক আগে রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে। অনেকগুলো পরিবার ঘরবাড়ি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এখন আমাদের নতুন জমি খুঁজতে হবে।
দক্ষিণ আইচা গ্রামের পাশেই চরবাড়িয়া ইউনিয়নের লামছড়ি গ্রাম ভাঙছে কীর্তনখোলা নদী। বিগত সরকারের আমলে নদী ভাঙন রোধে তাৎক্ষণিক কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও এই বর্ষায় ভাঙন ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। তবে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দা দেলোয়ার হাওলাদার বলেন, দুই দফায় ভিটা বদলেছি। নদী আমাদের নিঃস্ব করে দিয়েছে। গত বছর কিছুটা কম ভাঙলেও এবার মনে হয় বেশি ভাঙবে। টানা বৃষ্টি আর জোয়ার-ভাটার স্রোতও প্রবল। পানি উন্নয়ন বোর্ড দুই বছর আগে ব্লক ফেললে কিছু এলাকা রক্ষা পায়। তবে এখন মারাত্মক আতঙ্কে আছি।
বরিশাল সদর উপজেলা অংশ পেরিয়ে আড়িয়াল খাঁ নদীর বাবুগঞ্জ অংশের বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের শিকারপুর ব্রিজসংলগ্ন এলাকায় ভাঙন চলছে। কয়েক বছরের ভাঙনে ব্রিজের আশপাশ এলাকার ফসলি জমিসহ বেশ কিছু স্থাপনা বিলীন হয়ে গেছে। অব্যাহত ভাঙন ব্রিজটিকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলেছে। বরিশাল বিমানবন্দর এলাকার খুব কাছাকাছি চলে এসেছে অপরাংশের ভাঙন।
আড়িয়াল খাঁ নদীর মুলাদী উপজেলা অংশের সফিপুর ইউনিয়নের ভেদুরিয়া থেকে ঘুলিঘাট পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার জায়গা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। উদ্বাস্তু হয়েছে প্রায় চার শতাধিক পরিবার। একই উপজেলার জয়ন্তী নদীতে মৃধারহাট, ষোলঘর, ভেদুরিয়া, বাটামারা, আলীমাবাদ এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। বানারীপাড়া ও উজিরপুর উপজেলার সন্ধ্যা নদীর অংশে দশটি ইউনিয়ন, বাকেরগঞ্জ উপজেলার কারখানা নদী অংশের চারটি ইউনিয়ন এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে।
বসতিপূর্ণ এমন ৮০টিরও বেশি স্থানে সাড়ে ১১ কিলোমিটার ভাঙনের অতিঝুঁকিতে আছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। ঝুঁকিপূর্ণ এসব স্থানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার, সড়ক, ফসলি জমি এবং মানুষের ঘরবাড়ি আছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বরিশালের নির্বাহী প্রকৌশলী জাবেদ ইকবাল বলেন, জেলার মধ্য দিয়ে বড় বড় যে নদীগুলো প্রবাহিত হয়েছে। যেমন- কীর্তনখোলা, সন্ধ্যা, তেতুরিয়া, আড়িয়াল খাঁ, মেঘনা নদী তীরবর্তী ৮০টিরও বেশি স্থান ভাঙন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভাঙন রোধে এসব স্থানে প্রায় ৬০ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। চিহ্নিত ৮০টির মধ্যে ৩৫টি স্থানের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। বাকি ৪৫টি স্থানে ভাঙন ঠেকাতে বরাদ্দ আসেনি। বরাদ্দ পেলে দ্রুতই কাজ শুরু করা হবে।
তিনি বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে নদী ভাঙন একটি প্রকট সমস্যা। প্রতি বছর বর্ষায় ভাঙন দেখা দেয়। বিশেষ করে অতিবৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাসে নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেও ভাঙন শুরু হয়। নদীর প্রবল স্রোতেও দেখা যায় ভাঙন। পানি উন্নয়ন বোর্ড এসব সমস্যা সমাধানে স্থায়ী পরিকল্পনা করছে।
বরিশালের সাধারণ নাগরিক সমাজ সংগঠনের আহ্বায়ক কাজী মিজানুর রহমান বলেন, ভাঙন দেখা দিলে ছোট ছোট প্রকল্প নিয়ে প্রকারান্তরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু কর্মকর্তার আর্থিক লাভ হয়। নদী ভাঙন রোধে প্রয়োজন দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা। হোয়াংহো নদীকে বলা হতো চীনের দুঃখ। নদীটি এত বেশি ভাঙতো যে লোকালয় হারিয়ে যেত। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে হোয়াংহো এখন আর ভাঙে না।
তিনি বলেন, এই অঞ্চলে নদী ভাঙন থাকবে। ভূমি রক্ষায় নদীর গতিপথ পর্যালোচনা করে মাস্টারপ্ল্যান গ্রহণ করলে নদী শাসন হবে, ভাঙনও রোধ হবে। সেসব না করে বালুর বস্তা আর ব্লক ফেলে বড় বড় এসব নদীর ভাঙন ঠেকানো সম্ভব না।