নৌ-পথে এক মাসে দক্ষিণাঞ্চলে ৩ দূর্ঘটনা : মানছে না বিধি-বিধান

কামরুন নাহার | ২২:৫২, জানুয়ারি ১৩ ২০২০ মিনিট

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ গত একমাসে দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথে ৩টি বড় ধরনের দূর্ঘটনায় ২টি নৌযান ডুবি এবং দুই যাত্রীর মৃত্যু ছাড়াও ১০ জনের বেশী আহত হয়েছে। সর্বশেষ গতকাল সোমবার রাতের প্রথম প্রহরে বরিশাল থেকে ঢাকাগামী যাত্রী বোঝাই ‘এমভি কীর্তনখোলাÑ১০’ নৌযানটির উপর ঢাকা থেকে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়াগামী ‘এমভি ফারহান-৯’ নামের অপর একটি যাত্রীবাহী নৌযান আছড়ে পড়লে দুই যাত্রী নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরো অন্তত ১০জন। হতাহতদের সকলেই কীর্তনখোলাÑ১০ নৌযানের লোয়ার ডেক যাত্রী। কীর্তনখোলা’র ডান পাশের লোয়ার ডেকের একটি বড় অংশই এ দূর্ঘটনা দুমড়ে মুচড়ে গেছে। মধ্যরাতের ঐ দূর্ঘটনায় দুটি নৌযানেরই সহগ্রাধিক যাত্রী আতংকিত হয়ে আর্তনাদ শুরু করে দেয়। ঐ সংঘর্ষে ও ধাক্কায় বেশীরভাগ কেবিন যাত্রী শয্যা থেকে মেঝেতে পড়ে গিয়ে কমবেশী আঘাত প্রাপ্ত হয়েছেন বলেও জানা গেছে। এমভি ফারহান-৯ নৌযানটি প্রথম শ্রেণীর হলেও তার হুইল হাউজে থাকা চালক/কাপ্তান আলতাফ দ্বিতীয় শ্রেণীর সনদ প্রাপ্ত। এ সময় নৌযানটির হুইল হাউজে আরেকজন সুকানীও ছিল। বিধি মোতাবেক নৌযানটি প্রথম শ্রেণীর কাপ্তান দিয়ে পরিচালন-এর কথা এবং চালক নিয়ন্ত্রন হারিয়েই ঐ দূর্ঘটনা ঘটিয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারনা করা হচ্ছে। দূর্ঘটনার সময় মেঘনা অববাহিকায় হালকা থেকে মাঝারী কুয়াশা ছিল। কীর্তনখোলাÑ১০’এর কাপ্তান নুরুল ইসলাম জানান, ‘অনেক দুর থেকেই ফারহান লঞ্চটিকে নিয়ন্ত্রনহীন মনে হচ্ছিল তাদের কাছে। তাই বার বার হুইসাল বাজানসহ ওয়ারলেস যোগে আমরা সতর্ক করছিলাম। কিন্তু তাতে কোন সারা দেয়নি ফারহানের চালক। শেষ পর্যন্ত আমোদের নৌযানটির ওপর আছড়ে পরে বিপুল ক্ষতি সাধন করেছে ফারহান’। তার মতে, ‘মূলত ঐ ধরনের নৌযান পরিচালন-এর দক্ষতা ও সনদ ছিল না ফারহান-৯’এর চালকের’। এ নিয়ে গত এক মাসে দক্ষিণাঞ্চলে ৩টি বড় ধরনের দূর্ঘটনা ঘটল। গত ১৪ ডিসেম্বর রাতে বরিশাল বন্দরের বিপরীতে কীর্তনখোলা নদীতে বরগুনা থেকে ঢাকাগামী যাত্রী বোঝাই নৌযান ‘এমভি শাহরুখÑ২’এর আঘাতে ১২শ টন ক্লিংকার বোঝাই ‘এমভি হাজী মোঃ দুদু মিয়া(রঃ)’ ডুবে যায়। ক্লিংকার বোঝাই নৌযানটির সব ক্রুরা নিরাপদে তীরে উঠতে সক্ষম হলেও নৌযানটি এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ফলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বরিশাল নদী বন্দরের নিরাপদ পরিচালন ব্যবস্থা এখনো মারাত্মক ঝুকির মুখে। এমভি শাহরুখ-এর চালকও ছিল দ্বিতীয় শ্রেণীর সনদপ্রাপ্ত। অথচ নৌযানটি ছিল প্রথম শ্রেণীর। গত সোমবার ০৬ জানুয়ারী রাতে বরিশালের বানরীপাড়ার সন্ধ্যা নদীতে পিরোজপুর থেকে ঢাকাগামী যাত্রীবাহী নৌযান ‘এমভি মর্ণিং সানÑ১’এর সাথে সংঘর্ষে স্থানীয় পণ্যবাহী নৌযান ‘এমবি বসুচর’ নিমজ্জিত হয়। প্রায় দেড়শ টন পোল্ট্রি ফিড বোঝাই নৌযানটি দূর্ঘটনার সাথে সাথেই ডুবে গেলেও ভাগ্যক্রমে এর চালক ও ক্রুরা সাতরে কিনারায় উঠতে সক্ষম হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরীন রুটে চলাচলকারী কোন বেসরকারী নৌযান বিধি মোতাবেক বিআইডব্লিউটিএ’র পাইলট নিয়ে চলাচল করছেনা। এ সংক্রান্ত আইন কাগজে থাকলেও নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ও তার অধিন্যস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো তা প্রয়োগে নুন্যতম কোন পদক্ষেপ গ্রহন করছেনা বলেও অভিযোগ রয়েছে। উপরন্তু দেশের অভ্যন্তরীন নৌপথে চলাচলকারী বেশীরভাগ নৌযানই বিধি মোতাবেক ‘নেভিগেশন লাইট’গুলো যথা নিয়মে প্রজ্জলিত না করা সহ চলাচলের সময় ‘লুক আউট ডিউটি’তে কোন কর্মী না রাখারও অভিযোগ রয়েছে। এমনকি কুয়াশার মধ্যে নৌযানসমুহ চলাচলে বিধি বিধানও অনুসরন করছেনা বেশীরভাগ বেসরকারী নৌযানসমুহ। নৌ-পথে জারীকৃত সতর্কতা সহ নিরাপদ নৌযান চলাচলে ‘বয়া-বিকন’ সহ নৌ সংকেত ব্যবস্থা অনুসরন না করারও অভিযোগ রয়েছে বেশীরভাগ নৌযানের চালকদের বিরুদ্ধে। এ পর্যন্ত যত দূর্ঘটনা ঘটেছে তার বেশীরভাগই বিধি বিধান ভংগের কারনে বলে জানিয়েছেন একাধিক নৌ বিশেষজ্ঞ। গত ২৪ ডিসেম্বর রাতের শেষ প্রহরে বরিশালের অদুরে চরমেনাই-এর কাছে পথ হারিয়ে ‘এমভি মধুমতি’ নামের যাত্রীবাহী নৌযানটি ডুবো চরে উঠে যায়। প্রায় ১০ ঘন্টা পড়ে ভরা জোয়ারে নৌযানটি চড়া মূক্ত হয়ে নির্ধারিত সময়ের ১২ ঘন্টা পরে বরিশালে পৌছে। প্রায় ৫শ যাত্রী নিয়ে বিআইডব্লিউটিসি’র ঐ নৌযানটি ঢাকা থেকে চাঁদপুর হয়ে বরিশালে আসছিল। নৌযানটিতে অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতি ছাড়াও প্রথম শ্রেণীর কাপ্তানও ছিল। কিন্তু বিধি মেনে বিআইডব্লউটিএ’র সংকেত অনুসরন করে নৌ পথ অতিক্রম না করার কারনেই দূর্ঘটনা ঘটে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। এমনকি দেশের অভ্যন্তরীন নৌপথে চলাচলকারী বেসরকারী নৌযান চালকদের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বর্তমানে বরিশালÑঢাকা সহ বিভিন্ন রুটে দেশের সর্বাধিক দৈর্ঘ্যরে প্রথম শ্রেণীর নৌযান যাত্রী পরিবহন করলেও তাতে বিধিমোতাবেক কাপ্তান নিয়োগ দেয়না নৌযান মালিকগন। ফলে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রন হারিয়ে দূর্ঘটনা ঘটছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। বর্তমান শীতকালে প্রতিরাতেই মেঘনা অববাহিকা ঘন কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে। পাশাপাশি শুষ্ক মৌসুম শুরু হওয়ায় বিভিন্ন চ্যানেলগুলোতে গভীরতা হ্রাসের ফলে তা সরু হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বিআইডব্লিউটিএ’র তরফ থেকে নিরাপদ নৌ চলাচলের স্বার্থে হালকা কুয়াশায় ধীর গতিতে এবং ঘন কুয়াশায় নৌযানসমুহ নোঙরে রেখে প্রয়োজনীয় বাতি প্রজ্জলন সহ ঘন ঘন ‘ফগ সিগন্যাল ও বেল’ বাজানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতেও বলা হয়েছে।