নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরিশাল নগরীতে ক্লিনিক, ল্যাব ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ প্রায় দেড়শ বাণিজ্যিক চিকিৎসাকেন্দ্রে চলছে উপরে ফিটফাট ভিতরে সদরঘাট। স্বাস্থ্য দপ্তরের নিবন্ধন পেতে যেকয় ধরনের সনদ থাকা দরকার তা এই সকল প্রতিষ্ঠানগুলোতে রয়েছে কেবল নামমাত্র। তবে এই সনদগুলো পাওয়ার ক্ষেত্রে যেসকল শর্তাবলী থাকতে হয় তার অধিকাংশই অনুপস্থিত। ক্লিনিক, ল্যাব ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার করার ক্ষেত্রে চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে পরিবেশ, ফায়ার সার্ভিস, পরমাণু কমিশনসহ প্রায় ১০/১২ ধরনের সনদ থাকলেই স্বাস্থ্য দপ্তরে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা যায়। অনুসন্ধান সূত্রে জানা গেছে, নিবন্ধন পাওয়ার জন্য আবেদনপত্রে ফায়ার সার্ভিসের সনদ থাকতে হয়। আর ফায়ার সার্ভিসের সনদ পাওয়ার ক্ষেত্রে যে সকল অবকাঠামোর দরকার তা হলো স্ট্রিংগুয়েসর, নির্দিষ্ট দূরত্বে পানির লাইন রাখা, নির্দিষ্ট মাপের সড়ক যাতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি অনায়াসে আসা-যাওয়া করতে পারে। অথচ নগরের বাটার গলি, বেলভিউ গলি, প্যারারা রোডসহ স্থানগুলোতে ভালোভাবে রিক্সা কিংবা মোটরসাইকেল চলাচল করতে পারে না। সেক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশের কোনো সুযোগই নেই। তাহলে ফায়ার সনদ পেল কিভাবে? এব্যাপারে নগরীর ফায়ার সার্ভিস দপ্তরের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো: হাসান আলী বলেন, আগে কিভাবে ফায়ার সনদ নিয়েছে জানিনা তবে এখন থেকে বেশ কঠোরভাবেই বিষয়টি পর্যবেক্ষন করেই ফায়ার সনদ দেয়া হবে। কিন্তু নিবন্ধনের জন্য এধরনের সনদ যদি স্বাস্থ্য দপ্তরে জমা দেয়া হয় তাহলে সেই সনদের উপর ভিত্তি করে যদি স্বাস্থ্য দপ্তর নিবন্ধন দিয়ে দেয় তাহলে সেটা কতটা যথাযথ কিংবা নিরাপদ? শধু তাই নয়, ডায়াগনস্টিক ও প্রাইভেট হাসপাতালের এক্স-রে রুমের জন্য পরমাণু শক্তি কমিশনের সনদ অবশ্যই থাকতে হবে। কারন এক্স-রে যখন করা হয় তখন প্রতিটি ক্লিকে রেডিয়েশন তৈরি হয়। আর এই রেডিয়েশন মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু একজন রোগী ও এক্স-রে অপারেটরের জন্য এই রেডিয়েশনে কি ক্ষতি হতে পারে এনিয়ে নগরীর পরমাণু দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এক্সরের প্রতিটি ক্লিকে যে রেডিয়েশন তৈরি হয় তাতে বন্ধ্যাত্ব ও চর্মরোগ এবং মানসিক বিকারগ্রস্থতাও তৈরি হতে পারে। যে কারণে এক্স-রে রুমটা বিশেষভাবে তৈরি করা হয়। রুমটিতে ১০ ইঞ্চি ওয়াল ও বিশেষ একটি ধাতব প্লেট দেয়ালে লাগাতে হয় যাতে এক্স-রে রেডিয়েশনটি রোদ করা যায়। এরপর এক্স-রে মেশিনে কি পরিমান রেডিয়েশন তৈরি হয় তা নিরীক্ষার জন্য একজন রেডিয়েশন কন্ট্রোল অফিসার কে দিয়ে ভিজিট করাতে হয়। ইত্যকার আরো আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পরে পরমাণু শক্তি কমিশন থেকে সনদ দেয়া হয়। কিন্তু নগরীর অধিকাংশ ডায়াগনস্টিক ও ক্লিনিকগুলোতে এর উল্টো চালচিত্র রয়েছে। এমনকি শুধুমাত্র থাই গ্লাসের রুমে এক্স-রে মেশিন স্থাপন করে এক্স-রে সম্পন্ন করছে। সূত্রে জানা গেছে, রেডিয়েশনের একককে বলা হয় কুড়ি। একজন মানুষ সর্বোচ্চ আট থেকে দশ কুড়ি রেডিয়েশন সহ্য করতে পারে। তবে দৈনিক এর বেশি রেডিয়েশন হলেই তার শরীরের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের জন্য আরো বেশি ক্ষতিকর। রেডিয়েশনের বিষয়টা নিয়ে নগরীর বাটার গলিস্থ ন্যাশনাল, গ্লোব, সেবা, বগুড়া রোডস্থ পপুলার ডায়াগনস্টিক, প্যারারা রোডের বসুন্ধরা ডায়গনস্টিক সেন্টারসহ একাধিক ডায়গনস্টিক সেন্টারে কর্মরতরা অনেকেই জানেনা যে রেডিয়েশন কন্ট্রোল বিষয়টি কি? শুধু তাই নয়, ফায়ার সার্ভিসের সনদ তাদের থাকলেও ফায়ার সার্ভিসের ক্ষেত্রে যেসব শর্তাবলী উপস্থিত থাকা দরকার তাও নেই। এনিয়ে ন্যাশনাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক এমএ খালেক বলেন, আমাদের সব কিছুরই সনদ রয়েছে। কিন্তু সনদ পাওয়ার জন্য যেসকল শর্তাবলী রয়েছে তাকি আপনারা পুরোপুরি অনুসরণ করেছেন? জানতে চাইলে এর কোন সদুত্তর মেলেনি। কিন্তু এধরনের কাগুজে সনদ সমেত যদি নগরীর স্বাস্থ্য দপ্তরের লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্য আবেদন করা হয় আর এই নামসর্বস্ব সনদের উপর ভিত্তি করেই লাইসেন্স দেয়া হয় তাহলে নগরীতে নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা কতটুকু বাস্তবায়ন হবে জানতে চাইলে বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা: বাসুদেব বলেন, নগরীতে তালিকাভুক্ত ১শ ২৫টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এর বাইরেও প্রায় অর্ধশত ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে যেগুলোর কোনপ্রকার আবেদন নেই এবং এগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য একটি কমিটি নগরীতে কাজ করছে। আশাকরি দু'একদিনের মধ্যেই তাদেরও হদিস পেয়ে যাবো। আর লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্য যেসকল প্রতিষ্ঠান আমাদের কাছে আবেদন করেছে কিংবা নবায়নের জন্য আবেদন করেছে, তাদের আবেদনের সাথে যে সকল সনদ দেয়া হয়েছে সব সনদ এর বিপরীতে যে ধরনের অবকাঠামো বা শর্তাবলীর উপস্থিতি থাকা দরকার তা আমরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে লাইসেন্স দিবো। নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এর কোন বিকল্প নেই। প্রতিদিনই নগরীতে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। তিনি বলেন, যেসকল ক্লিনিক, ল্যাব ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মানহীন নিবন্ধনহীন এককথায় গোঁজামিল বা দুনম্বরী রয়েছে সেগুলোকে আমরা ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে সিলগালা করে দিচ্ছি এবং জড়িতদের জরিমানাসহ জেলে দেওয়া হচ্ছে। অবশ্যই জেনেছেন, ইতিমধ্যে সেন্ট্রাল ও মুন নামের দুটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার সিলগালা করে দেয়াসহ জেল জরিমানা করা হয়েছে। অপরদিকে প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতেও প্রতারণা থেমে নেই। এরমধ্যে নগীর একটি প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালে ভুয়া করোনা রোগী সাজিয়ে ২৭ হাজার টাকা লোপাট করা হয়েছে। এনিয়ে ভুক্তভোগী রোগী মুজিবুর রহমান (৭০)বলেন, চলতি মাসের ২৩ তারিখ ডাক্তার মুশফিকুর রহমানের অধীনে ভর্তি হই। সিটি স্ক্যানসহ যাবতীয় চেকআপ করে তারা বলেন, করোনা হয়েছে। এরপর আমাকে শেবাচিম হাসপাতালের করোনা ইউনিটে পাঠায়। কিন্তু সেখানে করোনা টেস্টে নেগেটিভ আসে। পরবর্তিতে ঢাকায় চিকিৎসা নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা আমাকে বলেন, করোনা হয়নি বরং কফ জমে ছিলো। তাহলে আমার প্রশ্ন হল আমার ২৭ হাজার টাকা কেন ব্যয় করালো এবং কেন করোনা ওয়ার্ডে পাঠানো হলো। আমি জানি এইধরণের ভোগান্তির কোন সুরাহা আমি পাবোনা, কারণ যারা এধরনের হাসপাতাল করে তাদের সুউচ্চ লবিং থাকে। শুধু তাই নয়, ঘটনার মূল বিষয় পাল্টে দিয়ে তাদের পক্ষপাতিত্ব নেয়ার জন্য নিজস্ব মিডিয়াও থাকে। যেমনটা ছিলো শাহেদের। উল্লেখ্য, সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ৩৯টি বেসরকারি ক্লিনিক হাসপাতালের মধ্যে মাত্র ১১টির লাইসেন্স রয়েছে। এবং ১শ ২৫টি ডায়গনস্টিক সেন্টারের মধ্যে লাইসেন্স আছে মাত্র ২৮টির। বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় ৯শ ৬১টি ক্লিনিক, ল্যাব ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে ৬শ ৬৪টি অনুমোদনহীন।