সরকারি বরিশাল কলেজের নাম পরিবর্তন নিয়ে উত্তেজনা

দেশ জনপদ ডেস্ক | ১৫:৩৬, জুলাই ১৫ ২০২০ মিনিট

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ সরকারি বরিশাল কলেজের নাম পরিবর্তন করে মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত সরকারি কলেজ নামকরণের পক্ষে-বিপক্ষে একই স্থানে একই সময়ে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালিত হয়েছে। গতকাল বুধবার (১৫ জুলাই) বেলা ১১টা থেকে দুপরে ১টা পর্যন্ত নগরীর অশ্বিনী কুমার হলের সামনে পরস্পর বিরোধী দুটি কর্মসূচি পালিত হয়। কর্মসূচির শুরুতে কিছুটা উত্তেজনা দেখা দিলেও পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। তবে একই স্থানে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিকে ঘিরে সকাল থেকেই কিছুটা উত্তপ্ত ছিল শহরের প্রাণকেন্দ্র সদর রোড এলাকা। ফলে সকাল থেকেই টাউন হলসহ সদর রোড কেন্দ্রিক বিভিন্ন পয়েন্টে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এ কারণে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে আন্দোলনের মাঠ উত্তপ্ত হলেও পুলিশের সতর্ক অবস্থানের কারণে ঘটেনি কোন সহিংষ ঘটনা। এর আগে গত মঙ্গলবার ওই স্থানে বিক্ষোভ সমাবেশ ও স্মারকলিপি প্রদান অনুষ্ঠানের ডাক দেয় বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ ও সমমনা দলগুলো। কর্মসূচি ঘোষণার খবর পেয়ে আধা ঘন্টার ব্যবধানে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি ও সমাবেশের ডাক দেয় সরকারি বরিশাল কলেজের পুরাতন ও নতুন শিক্ষার্থীর ব্যানারে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট একেএম জাহাঙ্গীর। জানাগেছে, স্থানীয় সংস্কৃতিজনদের অনুরোধে সাম্প্রতি ঐতিহাসিক সরকারি বরিশাল কলেজের নাম পরিবর্তন করে মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত সরকারি কলেজ নামকরণের সুপারিশ মন্ত্রণালয় প্রেরণ করে বরিশাল জেলা প্রশাসন। সে অনুযায়ী এমন পরিবর্তনের বিষয়ে সুপারিশসহ মতামত চেয়ে বরিশাল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডে চিঠি প্রেরণ করে মন্ত্রণালয়। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর পরই প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালচনার ঝড় শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল বুধবার সকাল ১১টায় টাউন হলের সামনে পূর্বের ঘোষণা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের আগেই অশ্বিনী কুমার হলের সামনের সড়কে সরকারি বরিশাল কলেজ নামকরণ অপরিবর্তিত রাখার দাবিতে গণস্বাক্ষর কর্মসূচী শুরু করেন প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা। এই কর্মসূচির নেতৃত্বে ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সরকারি বরিশাল কলেজের সাবেক ভিপি এ্যাডভোকেট একেএম জাহাঙ্গীর। এছাড়া একই স্থানে মাহাত্মা অশ্বিনী কুমার সরকারি কলেজ নাম করণের দাবি এবং এর বিরোধীতাকারীদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে বিভিন্ন পর্যায়ের সাতটি সংগঠন। যার নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশেল সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) বরিশাল জেলা কমিটি। সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের ব্যানারে করা আন্দোলন কর্মসূচির নেতৃত্বে সরকার দলীয় নেতারা নেতৃত্বে থাকলেও এ কর্মসূচিতে বিএনপি দলীয় নেতারাও অংশগ্রহন করেন। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিলে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনার চেষ্টা করে। একপর্যায় বাসদের নেতাকর্মীরা রাস্তার বিপরীত পাশে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ চালিয়ে যায়। প্রায় দুই ঘন্টাব্যাপী উভয় পক্ষের কর্মসূচী মুখোমুখি অবস্থানে থেকে চলার পর বাসদের নেতাকর্মীরা পুনরায় বিক্ষোভ মিছিল সহকারে স্থান ত্যাগ করে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করতে যান। এসময় তাদের সাথে সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম, শহীদ আলতাব মাহমুদ স্মৃতি সংসদ, শিশু কিশোর মেলা বরিশাল জেলা শাখা এবং বরিশাল রিক্সা ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নসহ বিক্ষোভে অংশ নেয়। বিক্ষোভে নাম পরিবর্তনের পক্ষে বক্তারা বলেন, শিক্ষার বিস্তারে মহাত্মা অশ্বিনী কুমারের অবদান অনস্বীকার্য। মহাত্মার বসতভিটাটাই এখন বরিশাল কলেজ। অথচ সেখানে তার কোন নাম নেই। ‘মহাত্মা অশ্বিনী কুমার সরকারি কলেজ, বরিশাল’ নামে করার গেজেট নোটিফিকেশন দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানান বক্তারা। একই সাথে কলেজে অশ্বিনী কুমারের স্মৃতি রক্ষার্থে মিউজিয়াম ও ভাস্কর্য করার দাবি জানান। নেতৃবৃন্দ বলেন, বরিশাল কলেজের নাম পরিবর্তনের বিপক্ষে আজ আওয়ামীলীগ আওয়ামীলীগের বিপক্ষে দাড়িয়েছে। সাবেক সংসদ সদস্য তালুকদার মোঃ ইউনুস নিজে সংসদে দাড়িয়ে বরিশাল কলেজের নাম অশ্বিনী কুমার কলেজ করার দাবি তুলে ধরেছিলেন। আজ যখন সেটা বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে তখন আওয়ামীলীগই এর বিরোধিতা করছে। বাসদের আহবায়ক ইমরান হাবিব রুমনের সভাপতিত্বে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বাসদ বরিশাল জেলার সদস্য সচিব ডা. মনিষা চক্রবর্তী, বাসদ মার্কবাদী আহবায়ক সাইদুর রহমান, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের আহবায়ক সাগর দাস প্রমুখ। বক্তারা বলেন, মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত শুধু বরিশালের প্রাণপুরুষই নয়, পুরো ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে এই উপমহাদেশে নক্ষত্রের মত ভূমিকা রেখেছেন অশ্বিনী কুমার দত্ত। বৃটিশ আমলে বরিশালের শিক্ষা, রাজনীতি এবং জ্ঞান অন্বেষণে পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। আকর্ষণীয় আইন পেশা ছেড়ে মানুষের জন্য জীবন বিলিয়ে গেছেন, পিতার নামে প্রতিষ্ঠা করেছেন ব্রজমোহন স্কুল (১৮৮৪), ব্রজমোহন কলেজ (১৮৮৯)। দুটো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই তৎকালীন অবিভক্ত বাংলা ও ভারতে শ্রেষ্ঠত্বের আসন অর্জন করে নিয়েছিল। তাঁর তত্ত্বাবধানে ও নেতৃত্বে ব্রজমোহন মহাবিদ্যালয় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ হিসেবে খ্যাত হয়েছিল। বরিশালের সামাজিক-রাজনৈতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে এই দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অবিস্মরনীয় হয়ে আছে। নেতৃবৃন্দ বলেন, আজকের বরিশাল কলেজ ছিল অশ্বিনী কুমার দত্তের বাসভবন। এই বাসভবনের অঙ্গনেই তার রোপন করা তমাল বৃক্ষতলে বরিশালের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বহু যুগান্তকারী তৎপরতার শুরু হয়েছিল। তিনি অর্জন করেছিলেন মহাত্মা খেতাব। দেশভাগের পরে তাঁর উত্তরাধিকারীগণ দেশত্যাগে বাধ্য হলেও, তাঁর বাসভবনে গড়ে ওঠে আরেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বরিশাল নাইট কলেজ। মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বাংলাদেশে ক্রমশ নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে কলেজটি সরকারীকরণের পরে ‘সরকারি বরিশাল কলেজ’ নামে স্বীকৃত হয়। বরিশালের প্রগতিশীল মানুষজনের প্রতিবাদের পরেও তার বাসভবনটি সংরক্ষণ না করে ভেঙ্গে ফেলা হয়। অশ্বিনী কুমারের বাসভবনে প্রতিষ্ঠিত বরিশাল কলেজে অশ্বিনী কুমারের স্মৃতি রক্ষার্থে প্রায় কিছুই নেই। তাই অবিলম্বে বরিশাল সরকারি কলেজের নামকরণ মহাত্মা অশ্বিনী কুমারের নামে করার প্রস্তাবনা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। এদিকে সরকারি বরিশাল কলেজ নামকরণ অপরিবর্তত রাখার দাবি নিয়ে গণস্বাক্ষর কর্মীসূচীর উদ্বোধক বরিশাল কলেজের সাবেক ভিপি ও বরিশাল মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতি কেএম এ্যাড. জাহাঙ্গীর তার বক্তব্যে বলেন, বরিশাল কলেজের জমি কেউ দান করেনি, এটা খরিদ করা হয়েছে। ১৯৬৩ সালে যখন এই কলেজটি নাইট কলেজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তখনও ছিল বরিশাল নাইট কলেজ। স্বাধীনতার পরে এটি ডে এবং নাইট কলেজ রুপান্তরিত হয়। এখন এই কলেজটি বাংলাদেশ জুড়ে বরিশাল কলেজ নামে পরিচিতি লাভ করেছে। তবে এখন যে পক্ষে-বিপক্ষের ব্যাপার দাঁড়িয়েছে এটা অত্যান্ত দুঃখজনক। এসময় বরিশাল কলেজ নামকরণ অপরিবর্তিত রাখার দাবি জানান তিনি।