নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরিশালের একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠেছিল বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজ। অল্প দিনেই সুনাম ছড়িয়েছিল বিভাগ জুড়ে। কিন্তু একের পর এক কেলেংকারীতে স্কুলটির সুনাম আজ শুন্যের কোঠায়। প্রতিনিয়ত পত্র-পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষকদের অন্তঃর্দ্বন্দ্ব ও বিতর্কিত কর্মকান্ডে প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যত নিয়ে শংকিত শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। বর্তমানে করোনার এই দুর্যোগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদেরকে ফোন ও ম্যাসেজে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বেতনের টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটির ফান্ডে পর্যাপ্ত টাকা থাকা সত্ত্বেও মে থেকে আমন্ত্রিত ২১ শিক্ষক ও কর্মচারিদের বেতন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া মে মাসের মুল বেতন দেয়া হয়েছে ৪০ সরকারি শিক্ষক ও কর্মচারিদেরকে। প্রতিষ্ঠানটি মার্চ থেকে বন্ধ থাকলেও মাসিক বেতন ও অন্যান্য ফি’র জন্য শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের কাছে বারবার ফোন ও ম্যাসেজ দেয়ায় ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা। সুত্র জানিয়েছে, চলতি মাসে এডহক হয়ে গেলে সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মত ফি নিতে হবে। তাই এখন আদায় না করা হলে পরে আর আদায় করতে পারবেনা এমন মানসিকতা থেকেই অভিভাবকদের চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। মিজানুর রহমান নামের একজন অভিভাবক বলেন, ‘করোনায় অফিস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমাদের বেতন বন্ধ হয়ে আছে। এই অবস্থায় সংসার চালানোয় দায় হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে স্কুল থেকে বেতনের জন্য ফোন করে চাপাচাপি করা হচ্ছে। এই অবস্থায় সংসার চালাব নাকি সন্তানের স্কুলের বেতন দিব ?’ সোহরাব নামে অপর এক অভিভাবক বলেন, বন্ধ স্কুলে ম্যাসেজ করে মার্চ মাস থেকে জুন পর্যন্ত পুরো চার মাসের বেতন একসঙ্গে চাওয়া হচ্ছে। বিষয়টা অভিভাবকদের জন্য বিব্রতকর। গত চার মাস ধরে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। সেখানে ম্যাসেজ করে টাকা চাওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত তা ভাববার বিষয়। গত জানুয়ারিতে সব স্কুলে ভর্তিতে সেশন ফির নামে মোটা অঙ্কের টাকা নেওয়া হয়েছে। তারপর মাত্র দু মাস স্কুল চলার পরই বন্ধ হয়েছে। পরবর্তীতে কবে স্কুল খুলবে সেটাও অনিশ্চিত। সেখানে স্কুল কর্তৃপক্ষের বেতনের ভাবনা আসে কোথা থেকে? অপরদিকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে স্কুল বন্ধ থাকার কারণে স্কুলের অন্যান্য খরচও হয়নি। বিদ্যুৎ, পানি, চক, ডাস্টার কিংবা কাগজ-কলমে কোনো খরচ হয়নি। সেখানে পুরো বেতনের প্রসঙ্গ আসে কিভাবে ? এদিকে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ পরিচালনা পর্ষদকে এড়িয়ে নিজেই সব সিদ্ধান্ত একা নিচ্ছেন। পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সভাপতি তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার এর কোন আদেশ বর্তমান অধ্যক্ষ মানে না। নিজ ইচ্ছামত পরিচালনা করছেন প্রতিষ্ঠানটি। সাবেক বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার একটি আদেশ দিলে অধ্যক্ষ সে আদেশ না মানায় বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি অধ্যক্ষকে শোকজ করেছেন। সে বিষয়টি বাস্তবায়ন না করার জন্য ৯ জুলাইয়ের মধ্যে ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়। অধ্যক্ষ ইতিমধ্যে অসত্য তথ্য দিয়ে একটা লিখিত ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। এদিকে অধ্যক্ষের স্বেচ্চাচারিতা খামখেয়ালিপনা ও একক একটি অমানবিক আদেশে প্রতিষ্ঠানটির ২১ শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মে মাস থেকে বেতন বন্ধ। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে তহবিল তসরুপ, শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের আদেশ অমান্যসহ ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ শিক্ষকদের। মে মাস থেকে বেতন বন্ধ হওয়ায় ২১ শিক্ষক ও কর্মচারিদের পরিবারে চরম অনিশ্চয়তা ও হতাশা দেখা দিয়েছে । ১৭ মে’ ২০২০ তারিখ বেতন বন্ধের অধ্যক্ষের অবৈধ আদেশ প্রত্যাহারের জন্য ২১ জন খন্ডকালীন শিক্ষক ও কর্মচারীরা পৃথক পৃথক আবেদন করেছেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও বরিশালের বিভাগীয় কমিশনারের নিকট। ১৭ মে বৈশ্বিক মহামারি করোনা চলাকালীন সময়ে নিয়মিত বেতন প্রদান শিরোনামে তারা আবেদন করেন। এদিকে ১১ জুন বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজের ৪০ জন স্থায়ী শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও বিভাগীয় কমিশনার বরাবরে বেতন ভাতা সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী আত্তীকরন না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত রাখার শিরোনামে আবেদন করেন। আবেদনে ৪০ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীগন উল্লেখ করেন মে’ ২০২০ মাসের বেতন ভাতা জুনের ১০ তারিখ পর্যন্ত পায়নি। এ বিষয়ে অধ্যক্ষের সাথে শিক্ষরা আলোচনা করলে তিনি জানান, কোন বেতন দেয়া হবেনা। কারন হিসিবে তিনি বলেন, ফান্ডে কোন টাকা নাই। আরো বলেন, সরকার শুধু এপ্রিল ও মে মাসের মুল বেতন দিতে বলেছে। এদিকে একাধিক শিক্ষক জানান, কলেজের প্রায় ৪০ লাখ টাকার ফান্ড ও তিন কোটি টাকার এফডিআর রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের যে নির্দেশনা রয়েছে তা সদ্য বা নতুন সরকারিকরনকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নন এমপিও শিক্ষকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। শুধু তাই নয়, ৪০ জন আবেদনকারী অধ্যক্ষ প্রসঙ্গে আবেদনে আরো উল্লেখ করেন, পরিতাপের বিষয় এই করোনা দুর্যোগ মুহুর্তে প্রতিষ্ঠানটির প্রেষনে নিয়োজিত অধ্যক্ষ করোনার অজুহাতে সু-কৌশলে পরিচালনা পর্ষদের কোন সভা আহবান না করে একক সিদ্ধান্তে বেতন না দেওয়ার দীর্ঘ সূত্রতা সৃষ্টি করছে। অথচ অধ্যক্ষ তার মুল বেতনসহ অন্যান্য ভাতাদি কলেজ ফান্ড থেকে গ্রহন করছেন। তারা আবেদনে আরো উল্লেখ করেন, অধ্যক্ষ যোগদানের তারিখ থেকে শতকরা বিশ ভাগ প্রেষন ভাতা গ্রহন করে আসছেন যা মন্ত্রনালয়ের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। শিক্ষক ও কর্মচারিরা বেতন ভাতা না পাওয়ায় তারা বেতন বন্ধের আদেশকে অন্যায় ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে সভাপতির নিকট মে মাসের বেতন ও এডহক না হওয়া পর্যন্ত নিয়মিত বেতন ভাতা অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন। এদিকে জুন মাসে সরকারি ৪০ জন শিক্ষক ও কর্মচারিদের আংশিক বেতন প্রদান করা হলেও ২১ জন আমন্ত্রিত শিক্ষক ও কর্মচারিদের বেতন প্রদান করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানটিতে স্থায়ীরা ক্লাশ কম নেন। খন্ডকালীন ও আমন্ত্রিত শিক্ষকরা অতিরিক্ত ক্লাশ নেন। অথচ এই করোনার মহামারিতে বেতন বন্ধের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন অধ্যক্ষ যা গভর্নিং বডি বা একাডেমিক কাউন্সিলের কেউ কিছু জানেন না। এদিকে অধ্যক্ষ নিজের মে, জুন ও ঈদের বোনাসসহ অন্যান্য বেতন প্রস্তুত করে পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি, বিভাগীয় কমিশনার বরাবরে পাঠিয়েছেন। খন্ডকালীন শিক্ষকদের বেতন বন্ধের ব্যাপারে সহকারি শিক্ষক (গনিত) মোঃ আজিম উদ্দিন জানান, এপ্রিলের বেতন যখন দেয়া হয় তখন মে মাস থেকে আমাদের বেতন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে বলে জানিয়ে দেয়া হয়। আমরা আমন্ত্রিত ও খন্ডকালীন শিক্ষকরা পরিচালনা পর্ষদের সভাপতির নিকট আবেদন করেছি নিয়মিত বেতন প্রদানের জন্য। তিনি বলেন, অধ্যক্ষের নির্দেশে প্রতিষ্ঠানটির হিসাবরক্ষন কর্মকর্তা আমির হোসেন আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। একই কথা বললেন সহকারি শিক্ষক (গনিত) মোঃ জাকির হোসেন। তিনি বলেন আমাদের মাত্র সামান্য টাকা বেতন তা বন্ধের সিদ্ধান্তে আমরা হতবাক। বেতন বন্ধের ব্যাপারে অফিস সহকারি মোঃ রাশেদুজ্জামান জানান, আমরা খন্ডকালীন আট কর্মচারি পরিচালনা পর্ষদের সভাপতির নিকট আবেদন করেছি নিয়মিত বেতন প্রদানের জন্য। আমাদের বেতন বন্ধের সিদ্ধান্ত অমানবিক। বেতন না পেলে আমরা কিভাবে চলবো কি খাবো। বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানান, প্রতিষ্ঠানটি সরকারি ঘোষণা হওয়ার আগে একজন শিক্ষার্থীর যে বেতন নেওয়া হতো, সরকারি ঘোষণা হওয়ার পরও তা-ই আছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের নিয়মিত টিফিন না দিয়েই প্রতি মাসে টিফিন বাবদ টাকা, কম্পিউটার ল্যাব খরচ এবং অজ্ঞাত অত্যাবশ্যকীয় ব্যয়ের নামে টাকা নেওয়া হচ্ছে। এসব খরচের জোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। অপরএক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, ‘সরকারি হিসেবে কার্যকর হওয়ার পরও বেসরকারির ফি আদায় করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হচ্ছে শিক্ষকরা এখনো সরকারি সুযোগ পাননি। তাদের সরকারি বেতন চালু হলে শিক্ষার্থীদের থেকে আর বাড়তি ফি নেওয়া হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে শিক্ষকদের যদি এরিয়ারসহ ঘোষণার দিন থেকে বেতন দেওয়া হয়, তখন কি তারা ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে নেওয়া বাড়তি টাকা ফেরত দেবেন?’ ২০১৭ সালে সরকারি ঘোষনা হওয়ার পরেও এখনো শিক্ষার্থীদের মাসিক ৫৫০ টাকা হারে বেতন, প্রতিবছরের শুরুতে প্রদান করতে হচ্ছে সেশন ফি সহ উচ্চহারে ভর্তি ফিসহ অন্যান্য ফি। বরিশাল জেলা বাসদ সদস্য সচিব ডা. মনীষা চক্রবর্তী বলেন, মহামারী করোনার সময়ে শিক্ষার্থীদের বেতন-ফি মওকুফ করতে হবে। এই মুহূর্তে শিক্ষার্থীদের ওপর নতুন করে বোঝা চাপানো যাবে না। শিক্ষার্থীদেরকে চাপ প্রয়োগ করে বেতন আদায় দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন তিনি। এ ব্যাপারে বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ সাহিদুর রহমান মজুমদারের সাথে যোগাযোগের জন্য কলেজের টেলিফোনে কল করা হলেও রিসিভ করেননি।