স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও হয়নি স্মৃতিস্তম্ভ : অবহেলায় পটুয়াখালীর সুতাবাড়িয়ায় শহীদদের বধ্যভূমি

নিজেস্ব প্রতিবেদক | ১৮:৩২, ডিসেম্বর ১৮ ২০২৫ মিনিট

১৯৭১ সালের ৮ মে, শনিবার। সারা দেশে তখন পাক হানাদার বাহিনীর তাণ্ডব চলছিল। তবুও অন্য দিনের মতোই সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে পূজোয় বসেন সদ্য বিবাহিত নিখিল দাসের স্ত্রী মিনতি দাস। পূজা শেষ করে রান্নার কাজে মনোযোগ দেন। হঠাৎ দূর থেকে হট্টগোলের শব্দ শুনে ঘর থেকে বাইরে আসেন। তখনই বাড়ির অদূরে খালের পাড়ে দেখতে পান সেনাবাহিনীর বড় একটি গানবোট ঘাটে ভিড়েছে। সেখান থেকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে একে একে নেমে আসে সৈন্যরা। এক মুহূর্ত দেরি না করে বাড়িতে থাকা বৃদ্ধ শাশুড়িকে নিয়ে বাড়ির পেছনে থাকা ঘন কলাগাছের ঝোপে পালিয়ে লুকিয়ে পড়েন। খানিক বাদেই শুরু হয় গুলির শব্দ। প্রায় দুই ঘণ্টা যাবৎ গুলির শব্দের পর দুপুরের আজানের আওয়াজ শোনা যায়। তখন ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে দেখেন, বাড়ির পাশে দুলাল দাস (২৫), পিতা শচীন্দ্র দাসের নিথর দেহ পড়ে আছে। কথাগুলো বলতে বলতে মিনতি দাসের কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে আসে, আর নিজের অজান্তেই চোখের কোণে জল জমে ওঠে। মিনতি দাস আরও বলেন, ভগবানের কৃপায় ওই দিন আমার স্বামী বাড়িতে ছিল না। সকালে তার অসুস্থ মামাকে দেখতে পার্শ্ববর্তী উপজেলা বাউফলে গিয়েছিল। জানা যায়, সময়টা ছিল আনুমানিক সকাল ১১টা, ১৯৭১ সালের ৮ মে। খরস্রোতা কমলাকান্ত খালের ঘাটে পাক হানাদার বাহিনীর একটি গানবোট এসে নোঙর করে। এই খালের দুই পাশেই ছিল হিন্দু অধ্যুষিত দুটি গ্রাম—সুতাবাড়িয়া ও কুন্ডপাড়া (মাঝগ্রাম)। প্রায় ২০-২৫ জন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাক হানাদার বাহিনীর সদস্য স্থানীয় কয়েকজন রাজাকার ও আলবদরের সহযোগিতায় কিছু বুঝে ওঠার আগেই গ্রামের সাধারণ মানুষের ওপর মেশিনগানের গুলি ছুড়তে থাকে। মুহূর্তের মধ্যেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দিগ্বিদিক ছুটে যাওয়া মানুষগুলো। এরপর একে একে ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। কিছু কিছু বাড়িতে রাজাকাররা লুটপাট চালায়। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে দেখা যায় অর্ধশত নিরীহ মানুষের গুলিবিদ্ধ লাশ। প্রতিবেশী গ্রামের লোকজন সন্ধ্যার আগে এসে লাশগুলো যার যার বাড়িতে নিয়ে মাটি চাপা দেয়। বর্বরোচিত এ গণহত্যায় অনেকের নাম-পরিচয় আজও পাওয়া যায়নি। সুতাবাড়িয়া গ্রামের রবিন মালাকার জানান, ওই দিন গোলাগুলির শব্দ শুনে এলোপাতাড়ি ছুটে অনেক দূরে চলে যান। ভাগ্য ভালো যে গুলি লাগেনি। বিকেলে ফিরে এসে আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের লাশ দেখতে পান। পরে তারা সৎকার না করে মাটি চাপা দিয়ে দেন। তিনি আরও বলেন, এই গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে গণকবর রয়েছে। এর মধ্যে নায়েবের বাড়িতে ৬টি, শশীদাসের বাড়িতে ৫টি, ঠাকুরবাড়িতে ৩টি, সন্নামত বাড়িতে ২টি, ভুমালি বাড়িতে ২টিসহ মোট ১৮টি গণকবর রয়েছে। এছাড়াও বিচ্ছিন্ন জায়গায় আরও অনেক কবর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। গণহত্যায় ২৭ জনের নাম-পরিচয় জানা গেলেও বাকিদের শনাক্ত করা যায়নি। স্বাধীনতার ৫৪-৫৫ বছর পার হলেও সেখানে বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়নি। স্মৃতি হিসেবে যতটুকু সমাধি সংরক্ষণ হয়েছে, তা পরিবারের অর্থায়নেই হয়েছে। শহীদ হওয়া পরিবারের সদস্য বাবু রঞ্জন সমাদ্দার জানান, স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য অনেক বছর আগে জমির কাগজপত্র জমা দেওয়া হলেও আজ পর্যন্ত তা নির্মাণ করা হয়নি। শুধু ২৫ মার্চ এলেই উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু ফুলের তোড়া দেওয়া হয়। গলাচিপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান জানান, প্রতি বছরই আমরা ওই গণকবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করি। অচিরেই উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সুতাবাড়িয়া বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।