বরিশাল জিলা স্কুলে আবাসন কেলেঙ্কারি

নিজেস্ব প্রতিবেদক | ১৫:১০, নভেম্বর ২৮ ২০২৫ মিনিট

  • স্কুলের তহবিলে মেরামত, নথিতে অব্যবহারযোগ্য
  • দায়িত্বশীল পদে দায়িত্বহীনতা  
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বসবাসের অনুপযোগী ঘোষণা করার জন্য আবেদন করলেও পরবর্তীতে নিজেই বসবাস শুরু করেন সেই ভবনে। এমনই কুটকৌশল চালিয়ে আবাসন ভাতা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে বরিশাল সরকারি জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম বিরুদ্ধে। তার দেখানো পথে হাটছেন স্কুলের অপর এক শিক্ষক মো. হোছাইন। সরকারি নীতিমালা উপেক্ষা করে প্রতিষ্ঠান থেকেই আবাসিক সুবিধা ভোগ করার পরও নিয়ম অনুসারে ভাড়া পরিশোধ না করেই আবাসন ভাতা আত্মসাত করে চলছেন বছরের পর বছর। এ ঘটনায় শিক্ষক সমাজ থেকে শুরু করে অভিভাবক মহলে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, সম্প্রতি নুরুল ইসলাম প্রধান শিক্ষক হিসেবে বরিশাল সরকারি জিলা স্কুলে যোগদান করেন। যোগদানের পরপরই বিদ্যালয়ের তহবিল ব্যবহার করে নিজের ব্যবহারের জন্য স্কুলের কোয়ার্টারটি সংস্কার করান তিনি। সংস্কার শেষে অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে তিনি সেখানে বসবাস শুরু করেন। কিন্তু সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, কোনো শিক্ষক যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবাসিক সুবিধা ভোগ করেন, তবে তিনি আবাসন ভাতা বা হাউস রেন্ট পাওয়ার অধিকারী নন। এই নিয়ম অমান্য করেই প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম কোয়ার্টারটিকে ‘বসবাসের অনুপযোগী’ দেখিয়ে বেতন থেকে বাড়িভাড়া না কাটার আবেদন করেন বরিশাল শিক্ষা প্রকৌশলী অধিদপ্তরে। আবেদনের পর শিক্ষা প্রকৌশলী অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী এইচ এম আব্দুর রহমান ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মামুন সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। তাদের প্রতিবেদনে প্রধান শিক্ষকের কোয়ার্টারটিকে “ব্যবহারের অনুপযোগী” উল্লেখ করে মেরামতের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয় এবং কনডেম ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত বেতন থেকে বাড়িভাড়া না কাটার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে প্রতিবেদনে কোয়ার্টারটি ব্যবহারের অনুপযোগী ঘোষনা করার পরপরই প্রধান শিক্ষক সেখানে স্বাভাবিকভাবে বসবাস শুরু করেন। বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়, কোয়ার্টারটি প্রধান শিক্ষক স্কুলের ফান্ড থেকে সংস্কার করিয়েছেন এবং বর্তমানে সেখানে কোনো সমস্যা ছাড়াই বসবাস করছেন। অথচ সরকারি নথিতে কোয়ার্টারটিকে ‘অব্যবহারযোগ্য’ দেখিয়ে ভাড়া কর্তন বন্ধ করার চেষ্টা চালিয়েছেন। অন্যদিকে, প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলামের মূল বেতন ৭১,২০০ টাকা। বিধি অনুযায়ী তার হাউস রেন্ট ভাতা হওয়ার কথা মূল বেতনের ৪০ শতাংশ, অর্থাৎ ২৮,৪৮০ টাকা। কিন্তু অক্টোবর মাসে তার বেতন থেকে মাত্র ১২,০০০ টাকা ভাড়া বাবদ কর্তন করা হয়েছে। বাকি ১৬৪৮০ টাকা ভাড়া না দিয়ে আত্মসাত করেছেন। ভবিষ্যতে যাতে হাউস রেন্ট ভাতার পুরো টাকাই আত্মসাত করতে পারে সেজন্য কোয়ার্টারকে ‘অব্যবহারযোগ্য’ দেখিয়ে এ ধরনের কুটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। ফলে সরকারি কোষাগারে আর্থিক ক্ষতি হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক জানান, প্রতিবেদনে কোয়ার্টারটি বসবাসের অনুপযোগী ঘোষণা করা হলেও সেখানে বসবাস করলে হাউস রেন্ট ভাতার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে। যদিও তার এমন বক্তব্য প্রতিবেদনের কোথাও উল্লেখ করা নেই। তিনি আরও বলেন, গত মাসে (অক্টোবর) বাসা ভাড়া বাবদ মোট প্রাপ্ত ভাতার ৫০ শতাংশ অর্থাৎ ১৪ হাজার টাকা বাসা ভাড়ার বিপরীতে পরিশোধ করেছেন। তার ভাষায়, “যেহেতু আমি কোয়ার্টারেই থাকছি, তাই ভাড়া অবশ্যই দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট দপ্তর যে পরিমাণ নির্ধারণ করবে, সেটাই পরিশোধ করব।” কোয়ার্টারটি সংস্কার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক জানান, স্কুল ফান্ড ও তার ব্যক্তিগত খরচে কোয়ার্টারটির সংস্কার করা হয়েছে। আর সংস্কারে ঠিক কত টাকা ব্যয় হয়েছে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “বিলের কাগজ না দেখে সঠিক পরিমাণ বলা সম্ভব নয়।” এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) লুসিকান্ত হাজং বলেন, “সরকারি বরাদ্দকৃত বাসভবনে বিনা ভাড়া বা নামমাত্র ভাড়া দিয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। কেউ এমনটি করলে তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।” তিনি আরও বলেন, “জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষককে ঘিরে যে অভিযোগ উঠেছে, তা খতিয়ে দেখা হবে। তদন্তের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” একইভাবে বছরের পর বছর স্কুলের আবাসন সুবিধা ভোগ করলেও সরকারী কোষাগারে মাসিক ভাড়ার অর্থ জমা না দিয়ে দীর্ঘ দশ বছর ধরে বরিশাল জিলা স্কুলের ছাত্রাবাসে বসবাস করে আসছেন সহকারী শিক্ষক মো. হোছাইন। তিনি ২০০৬ সালে ইসলামী শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তবে অদৃশ্য ক্ষমতা বলে দেড় যুগ পার করেছেন ওই একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। জানা যায়, ২০১৫ সাল থেকে জিলা স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য নির্মীত ভবনের দ্বিতীয় তলায় প্রায় দুই হাজার বর্গফুটের ফ্লাটে স্বপরিবারে বসবাস করে আসছেন তিনি। নিয়ম অনুযায়ী, আবাসিক সুবিধা ব্যবহার করলে তার বেতন থেকে মাসে প্রায় ১৪ হাজার টাকা ভাড়া বাবদ কম নেওয়ার কথা। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে তিনি প্রতি মাসে পূর্ণ বেতন-ভাতা তোলেন এবং ভাড়া হিসেবে জমা দেন মাত্র ২ হাজার টাকা। অর্থাৎ সরকার নির্ধারিত প্রায় ১৪ হাজার টাকার আবাসন ভাতা তিনি নিয়মিত গ্রহণ করলেও রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেন তার অল্প অংশ। এহেন দুর্নীতির মাধ্যমে বিগত এক দশকে এই শিক্ষক সরকারি কোষাগার থেকে প্রায় ১৫ লাখ টাকা অবৈধভাবে আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই একই ছাত্রাবাসের নিচতলায় বসবাস করেন আবুল কালাম নামে অপর এক শিক্ষক। যিনিও একই নিয়মে প্রতিমাসে ভাড়া বাবদ মাত্র ২ হাজার টাকা পরিশোধ করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ছাত্রাবাসে আবাসিক ছাত্র না থাকায় সাবেক প্রধান শিক্ষকের অনুমতিতে দুই শিক্ষক সেখানে উঠেছিলেন। তবে মাসিক বেতন-ভাতা তোলার সময় বিল-ভাউচারে আবাসিক সুবিধা গ্রহণের তথ্য গোপন রেখে তারা দীর্ঘদিন ধরে পূর্ণ ভাতা উত্তোলন করেছেন। এ বিষয়ে অভিযুক্ত শিক্ষক মো. হোছাইন বলেন, “পরিত্যক্ত ছাত্রাবাসে থাকতে চাইলে সাবেক প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন অনুমতি দেন এবং প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা ভাড়া নির্ধারণ করে দেন।” বিল-ভাউচারে আবাসন সুবিধার তথ্য না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, “প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে এটি উল্লেখ করা হয়নি।” একই দাবি করেন ওই ভবনের নিচতলায় বসবাসকারী অপর শিক্ষক মো. আবুল কালামও। তবে বর্তমান প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম এসব বক্তব্যকে সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, “কোনো প্রধান শিক্ষকই মাসিক ভাড়া নির্ধারণ করেননি। ছাত্রাবাস প্রকল্পের পক্ষ থেকে বিদ্যালয়কে ২ হাজার টাকা করে ভাড়া গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।” এ নির্দেশনার লিখিত কোনো নথি আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি “অনেক পুরনো বিষয়” বলে মন্তব্য করে বিষয়টি এড়িয়ে যান। পুরো ঘটনাটি নিয়ে শিক্ষক সমাজ, অভিভাবক ও স্থানীয় সচেতন মহলে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। দায়িত্বশীল পদে থাকা শিক্ষকদের এমন অনিয়ম শুধু বিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেনি, বরং সরকারি কোষাগারও হারাচ্ছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রাজস্ব।