নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরিশাল শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সংলগ্ন বরিশাল অডিটোরিয়ামের সামনের ফাঁকা মাঠে জমিকে কেন্দ্র করে মুসলিম ইনস্টিটিউট ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের মধ্যে বিরোধ নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। মঙ্গলবার মুসলিম ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ‘মুসলিম ইনস্টিটিউট জামে মসজিদ’ নামের একটি টিনসেড মসজিদ নির্মাণ শুরু হলে এর পরের দিনই সাইনবোর্ড পরিবর্তন করে নিজেদের মালিকানা দাবি জানায় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। তাদের লাগানো নতুন স্টিকারে লেখা হয় “মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব (মুসলিম ইনস্টিটিউট), বরিশাল।” জমির মালিকানা নিয়ে দুই পক্ষের এই টানাপোড়েনে এলাকাজুড়ে দেখা দিয়েছে বিভ্রান্তি ও উত্তেজনা।
ঐতিহাসিক নথি অনুযায়ী, ১৯৩৭ সালে বরিশালের প্রভাবশালী জমিদার সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী ৩৩ শতাংশ জমিতে প্রতিষ্ঠা করেন মুসলিম ইনস্টিটিউট। ভাষা আন্দোলনসহ সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে এই প্রতিষ্ঠান বহুবার অগ্রণী ভূমিকা রাখে। পরবর্তীতে তার ওয়ারিশগণ জমির একটি অংশে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেন। সেই থেকে একই জমিতে দুটি প্রতিষ্ঠান পরস্পর সংলগ্নভাবে তাদের উপস্থিতি বজায় রেখেছে। শওকত হোসেন হিরণ মেয়র থাকাকালে মুসলিম ইনস্টিটিউটের দানকৃত কিছু জমির ওপর নির্মাণ করা হয় বঙ্গবন্ধু অডিটোরিয়াম (বর্তমানে বরিশাল অডিটোরিয়াম)। পরে সাদিক আবদুল্লাহর মেয়াদকালে রাতে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ভবন ভেঙে ফেলার অভিযোগও রয়েছে। জুলাই বিপ্লবের পর মুসলিম ইনস্টিটিউটের জমি পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হলে একটি কমিটি গঠন করা হয়। বিএম কলেজের ইসলামী শিক্ষা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর মোহাম্মদ আবদুর রবকে আহ্বায়ক এবং অ্যাডভোকেট সালাহউদ্দিন মাসুমকে সদস্য সচিব করা হয়।
এদিকে মুসলিম ইনস্টিটিউটের বর্তমান কমিটি ভূমি অফিসের রেকর্ড রুম থেকে ঐতিহাসিক নথিগুলো উদ্ধার করে। নথিতে দেখা যায় এসএ জরিপে জমির বড় অংশ মুসলিম ইনস্টিটিউটের নামে। এবং বিএস জরিপে কিছু অংশ মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের নামে। কমিটির দাবি, মূল দানপত্র তাদের হাতে রয়েছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী মোট জমির পরিমাণ ৩৩ শতাংশ। এর মধ্যে অডিটোরিয়ামে গেছে ৭ শতাংশ। অবশিষ্ট ২৬ শতাংশ জমি সিটি করপোরেশন মুসলিম ইনস্টিটিউটকে বুঝিয়ে দিয়েছে বলে তাদের দাবি। গত মঙ্গলবার সকালেই মাটি ভরাট ও টিনসেড নির্মাণের কাজ শুরু হয়। সাইনবোর্ডে ‘মুসলিম ইনস্টিটিউট জামে মসজিদ’ লেখা দেখে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়। কিন্তু একদিনের ব্যবধানে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সদস্যরা সাইনবোর্ডের ওপর স্টিকার লাগিয়ে নিজেদের মালিকানা দাবি করলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। “এখানে একই জমিতে দুই পক্ষের সাইনবোর্ড এটা তো নতুন ধরনের দৃশ্য। মালিকানার স্বচ্ছতা না থাকলে নির্মাণ নিয়ে এভাবে তাড়াহুড়া কেন?”
এদিকে জমি উদ্ধার কমিটির আহ্বায়ক এবায়েদুল হক চান অভিযোগ করে বলেন, “জমির চূড়ান্ত ফয়সালা হয়নি। এর আগেই শহীদ মিনার ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পাশে মসজিদ নির্মাণ গ্রহণযোগ্য নয়। এতে সামাজিক ও ধর্মীয় বিরোধের শঙ্কা বাড়বে।” তিনি আরও বলেন হাইকোর্টে মামলা চলমান, স্থাপনা নির্মাণে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। তবুও সদ্য বিদায়ী প্রশাসক রায়হান কাওসার নাকি অবৈধ সুবিধা নিয়ে মুসলিম ইনস্টিটিউটকে নির্মাণের অনুমতি দিয়েছেন। তবে তার দাবি, “আমরা আইনি লড়াই চালিয়ে জমি উদ্ধার করব।” অন্যদিকে মুসলিম ইনস্টিটিউটের নেতৃবৃন্দ জানাচ্ছেন, “এটি আমাদের জমি, যার দানপত্র প্রমাণ হিসেবে রয়েছে। জমি যাতে বেহাত না হয় তাই সিটি করপোরেশন ২৬ শতক জমি আমাদের নামে বুঝিয়ে দিয়েছে। মসজিদ নির্মাণ সম্পূর্ণ আইনসিদ্ধ।”
বরিশালের ঐতিহাসিক মুসলিম ইনস্টিটিউট ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের জমি নিয়ে টানাপোড়েন নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে মসজিদ নির্মাণকে কেন্দ্র করে। একদিনের ব্যবধানে সাইনবোর্ড পরিবর্তন, রেকর্ড রুমের নথি, দানপত্র ও অভিযোগপ্রতিযোগ সব মিলিয়ে ঘটনাটি এখন শহরের আলোচিত ইস্যু।