বরিশালে কেন এত বেশি পুলিশ যোদ্ধারা করোনায় আক্রান্ত?

দেশ জনপদ ডেস্ক | ২২:১৫, মে ২২ ২০২০ মিনিট

নিজস্ব প্রতিবেদক।। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে শুরু থেকেই সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ (বিএমপি)। মহানগরীতে বাহিরের লোকেদের প্রবেশ ঠেকাতে চেক পোস্ট, প্রবাস বা ঢাকা ফেরত ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত এবং লকডাউন কার্যক্রম বাস্তবায়নে জোড়ালো ভূমিকা পালন করছেন তারা। এর পাশাপাশি বরিশাল মহানগরীতে সর্বপ্রথম নগর পুলিশের উদ্যোগেই সকল সড়ক, মহাসড়ক জীবাণুনাশক স্প্রে এবং মানবিক সহায়তা প্রদান কার্যক্রমের ফলে শুরু থেকেই বেশ আলোচিত বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ। সাধারণ মানুষের খুব নিকটে গিয়ে এসব মানবিক এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে নিজেরাই এখন করোনাভাইরাসের আতঙ্কে রয়েছেন। কেননা শুরু থেকে মাত্র ৯ দিনের ব্যবধানে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের এই ইউনিটটির ২৭ সদস্য করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে। এর ফলে কিছুটা উদ্বিগ্ন নগর পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও। এমনকি আতঙ্ক ভর করেছে মাঠ পর্যায়ের সদস্যদের মধ্যেও। তাদের অভিযোগ হুঠ করে মার্কেট খুলে দেওয়া সিদ্ধান্ত এবং তার মধ্যে পুলিশের দায়িত্ব পালনে জনগণের মাঝে মিশে যাওয়াতেই পুলিশে সংক্রমণ বেড়েছে। অবশ্য রয়েছে ভিন্ন অভিযোগও। তবে এর পরেও দায়িত্ব পালনের দিক থেকে পিছ পা হচ্ছে না তারা। অজানা আশঙ্কা নিয়েই করোনা মোকাবেলায় দক্ষতার সাথেই কাজ করে যাচ্ছেন বিএমপি'র সদস্যরা। এমনকি এধরনের পরিস্থিতিতে মোটেও বিচলিত নন নগর পুলিশ প্রধান মো: শাহাবুদ্দিন খান। জানাগেছে, ‘সর্বপ্রথম গত ১১ মে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশে করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হয়। ওই দিন বিএমপি’র উত্তর জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার কার্যালয়ে অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মো. আবুল কালাম আজাদ এর গাড়ি চালকের কোভিড-১৯ পজেটিভ আসে। ওই দিনই নগরীর নথুল্লাবাদ এলাকাধীন লুৎফর রহমান সড়কে উপ-পুলিশ কমিশনার (উত্তর) এর কার্যালয় লকডাউন করা হয়। সেই সাথে ওই পিকআপ চালকের সংস্পর্শে আসা পুলিশ সদস্যদের নমুনা সংগ্রহ করে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের আরটি-পিসিআর ল্যাবে প্রেরণ করা হয়। প্রথম ধাপে গত ১৪ মে এক সাথে ৮ জনের করোনা ভাইরাস পজেটিভ আসে। যাদের মধ্যে একজন উপ-পরিদর্শক ও সাতজন কনস্টেবল। এর চার দিন পরেই গত ১৮ মে নতুন করে আরও চারজন আক্রান্ত শনাক্ত হন। এর মধ্যে তিনজন সহকারী উপ-পরিদর্শক ও একজন কনস্টেবল। যারা চারজনই কোতয়ালী মডেল থানায় কর্মরত। এর একদিন পরে অর্থাৎ ১৯ মে নতুন করে আরও ১২ জনের করোনাভাইরাস পজেটিভ আসে। যার মধ্যে একজন উপ-পরিদর্শক, একজন সহকারী উপ-পরিদর্শক, ছয়জন নায়েক ও একজন কনস্টেবল। এরা সবাই নগরীর নথুল্লাবাদে পিওএম শাখায় কর্মরত। সবশেষ ২০ মে নতুন করে তিনজন পুলিশ সদস্য’র করোনা পজেটিভ আসে। যার দু’জন বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের সদস্য। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের স্টাফ অফিসার (সহকারী পুলিশ কমিশনার) মো: আব্দুল হালিম জানিয়েছেন, ‘যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে ২১ জন বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালে আইসোলেশনে রয়েছেন। বাকি ছয়জন নিজ নিজ বাড়িতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এর আগে আরও ৩৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হলেও সেগুলো নেগেটিভ আসে। তার পরেও সতর্কতার কারণে তাদেরকে হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। তাছাড়া আরও ৩৫ জনের নমুনা পরীক্ষা অপেক্ষমান রয়েছে। তিনি বলেন, ‘করোনা আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের দেখভালের জন্য একটি করোনা ম্যানেজমেন্ট টিম রয়েছে। যেখানে তিনজন ডিসি (উপ-পুলিশ কমিশনার), তিন জন এসি (সহকারী কমিশনার) ও চার থেকে পাঁচজন পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) রয়েছে। এরাই আক্রান্ত এবং তাদের পরিবারের খাবার থেকে শুরু করে সার্বিক বিষয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছেন। এদিকে নগর পুলিশে একের পর এক আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় করোনা নিয়ে আতঙ্ক বাড়ছে মাঠ পর্যায়ে কর্মরত সদস্যদের মধ্যে। আর তাই মাঠ পর্যায়ে করোনা পরিস্থিতিতে শুরু থেকে যে আত্মবিশ্বাস ছিল তার অনেকটাই ঘাটতি পেয়েছে বলে দাবি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু পুলিশ সদস্যদের। তার পরেও করোনার ক্রান্তিকালে জনগণের পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তারা। অপরদিকে শুরুতেই বাবুগঞ্জে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেকজনক হারে বাড়তে থাকে। এ কারণে ওই উপজেলার মানুষদের নগরীতে প্রবেশ ঠেকাতে প্রতিটি পয়েন্টে চেক পোস্ট বসায় নগর পুলিশ। কিন্তু তার মধ্যেও উত্তর জোনের কিছু পুলিশ সদস্য প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে একাধিকবার বাবুগঞ্জে আসা যাওয়া করতে হয়েছে আর এ কারনে সেখান থেকেই ওই চালকের করোনায় সংক্রমিত হয়েছে বলে মনে করেন ডিসি (উত্তর) এর কার্যালয়ে কর্মরত একাধিক সূত্রের। যদিও বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের স্টাফ অফিসার ও সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. আব্দুল হালিম বলেন, ‘ওই চালকই যে প্রথম আক্রান্ত হয়েছে সেটা বলা সম্ভব নয়। তবে ডিসি (উত্তর) কার্যালয়ের ওই চালকের প্রথম করোনা শনাক্ত হয়েছে। করোনা ভাইরাসের পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে এখন কে আক্রান্ত এবং কে আক্রান্ত না সেটা বলা মুশকিল। কেননা আক্রান্ত অনেকের মধ্যেই উপসর্গ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘আমাদের পুলিশ সদস্যদের বিভিন্ন চেক পোস্টে কাজ করতে হচ্ছে। করোনার প্রদুর্ভাব ঠেকাতে একেবারে সাধারণ মানুষের সাথে মিশে গিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। আর এটা করতে গিয়ে কার মধ্যে থেকে এই ভাইরাস পুলিশের মধ্যে ছড়িয়েছে সেটা খুঁজে বের করাটা দুঃসাধ্য ব্যাপার বলে মন্তব্য করেন পুলিশের এই কর্মকর্তা। অবশ্য নগর পুলিশের কিছু সূত্র বলছে, মেট্রোপলিটন পুলিশে হঠাৎ করে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে ঈদ মার্কেট/শপিংমল খুলে দেওয়ার কারণ থাকতে পারে। গত ১০ মে ঈদ মার্কেটিংয়ের কারণে দোকান-পাঠ খুলে দেয়া হয়। এর ফলে নগরীতে বিভিন্ন উপজেলা থেকে মানুষ আসতে থাকায় ভীড় বেড়ে যায়। ফলে তাদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে জনগনের সাথে মিশে গিয়ে কাজ করতে হয়েছে পুলিশ সদস্যদের। আর ঈদ মার্কেট চালুর দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ১১ মে থেকেই নগর পুলিশে করোনা আক্রান্ত শনাক্ত বাড়তে থাকে। সার্বিক বিষয়ে আলাপকালে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো: শাহাবুদ্দিন খান-বিপিএম (বার) বলেন, ‘করোনা ভাইরাস নিয়ে সারা বিশ্বেই এখন উদ্বেগ উৎকন্ঠা রয়েছে। সেখানে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ সদস্যদের করোনা সংক্রমণের ঘটনা কিছুটা উদ্বিগ্নের। তবে এতে আমরা মোটেই বিচলিত নই। তিনি বলেন, ‘মেট্রোপলিটন পুলিশে দুই হাজারের বেশি সদস্য। সেখানে ২৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এতে করে আমাদের কার্যক্রম কোনভাবেই ব্যাঘাত ঘটছে না। তাছাড়া যারা আক্রান্ত হয়েছেন তারা সবাই সুস্থ আছেন, ভালো আছেন। আমার বিশ্বাস খুব দ্রুতই তারা পুরোপুরিভাবে সুস্থ হয়ে পুনরায় তারা করোনা যুদ্ধে ফ্রন্ট লাইনে থেকে কাজ শুরু করবে। পাশাপাশি অতি জরুরী প্রয়োজন ছাড়া সাধারণ মানুষকে ঘরের বাইরে বের না হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানান তিনি।