মির্জা রিমন ॥ বরিশালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করছে লক্ষাধিক কোমলমতি শিক্ষার্থী। জেলার ১,৫৮৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৩২৫টি বিদ্যালয় বর্তমানে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বছরের পর বছর বিদ্যালয়গুলোর ভবন জরাজীর্ণ হলেও সংস্কার কিংবা নতুন ভবন নির্মাণে কার্যকর পদক্ষেপের অভাব শিক্ষার্থীদের জীবনের নিরাপত্তা ও শিক্ষার অধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল জেলার বিভিন্ন উপজেলার অসংখ্য বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের ছাদ ও দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে নিয়মিত। কোনো কোনো স্থানে ছাদের বড় অংশ ভেঙে পড়ায় শিক্ষার্থীরা আহতও হয়েছে। এসব ভবনের অধিকাংশই ৩০ থেকে ৪০ বছর আগে নির্মিত, আর দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় এখন একেবারে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
বরিশাল জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্য অনুযায়ী, জেলার ১,৫৮৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৩২৫টি বিদ্যালয় বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ের অনেকগুলোতেই পাঠদান কার্যক্রম চলছে খোলা আকাশের নিচে। রোদ, বৃষ্টি কিংবা শীত সব কিছুর মাঝেই ছোট্ট শিক্ষার্থীরা মাটিতে বসে ক্লাস করছে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে পাঠদান প্রায় অচল হয়ে পড়ে। বরিশাল নগরীর বানী মন্দির সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গেলে ঝুঁকির বাস্তব চিত্র চোখে পড়ে। আশির দশকে নির্মিত ভবনটিতেই এখনো চলছে পাঠদান। ভবনটির তৃতীয় তলা ২০২২ সাল থেকে পরিত্যক্ত ঘোষিত হলেও প্রথম ও দ্বিতীয় তলার অবস্থা একইভাবে জরাজীর্ণ। শ্রেণিকক্ষের ছাদে বড় বড় ফাটল, দেয়ালের পলেস্তারা খসে মেঝেতে পড়ে আছে স্তূপ করে। এই ভয়াবহ অবস্থার মধ্যেও প্রতিদিন প্রায় সাড়ে তিনশ’ শিক্ষার্থীকে পাঠদান করতে হচ্ছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুষমা ঘোষ বলেন, “প্রতিদিন আতঙ্ক নিয়ে ক্লাস নেই। না জানি কখন কোথা থেকে কোনো অংশ ভেঙে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটে যায়। অনেক কক্ষ ব্যবহার উপযোগী না থাকায় অল্প কয়েকটি কক্ষে গাদাগাদি করে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতে হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীদের শেখার পরিবেশ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।” তিনি আরও জানান, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বারবার লিখিতভাবে জানানো হলেও সংস্কারের কোনো উদ্যোগ এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। জেলার অনেক বিদ্যালয়েই ভবন এতটাই ভগ্নদশাগ্রস্ত যে সেখানে পাঠদান একেবারেই সম্ভব নয়। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখন খোলা আকাশের নিচে ক্লাস করছে। ফলে শিক্ষার মান যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি শিশুদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার আগ্রহও কমে যাচ্ছে। গৌরনদী উপজেলার এক অভিভাবক বলেন, “আমার মেয়েটা প্রতিদিন ভয় নিয়ে স্কুলে যায়। ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়লে যদি মাথায় লাগে, তাহলে কে দায় নেবে? সরকার উন্নয়নের কথা বলে, কিন্তু আমাদের গ্রামের স্কুলটা এখন ধ্বংসের মুখে।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বরিশাল জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল বলেন, “আগামী ডিসেম্বর মাস থেকে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর একটি বিস্তৃত জরিপ পরিচালনা করবে। জরিপ শেষে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে নতুন ডিজাইনে ছয়তলা ফাউন্ডেশনের ওপর চারতলা বিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করা হবে। সেখানে ছেলে-মেয়েদের জন্য আলাদা ব্লক, নিরাপত্তা প্রাচীর ও গেট নির্মাণেরও পরিকল্পনা রয়েছে।” তিনি আশা প্রকাশ করেন, জরিপের কাজ শেষ হওয়ার পরপরই ভবন নির্মাণের প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হবে।
তবে শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের মতে, শুধু পরিকল্পনা নয় দ্রুত বাস্তবায়নই এখন সময়ের দাবি। কারণ, প্রতিদিন শিশুদের জীবনের ঝুঁকি বাড়ছে, আর যে কোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়লেও মাঠপর্যায়ে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। অধিকাংশ বিদ্যালয়ের অবকাঠামো এখনো ৮০ ও ৯০ এর দশকের নির্মাণ, যা বর্তমান মানদণ্ডের সঙ্গে অসঙ্গত। শিশুদের নিরাপদ পরিবেশে শিক্ষা লাভের অধিকার সংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত। কিন্তু বরিশালের এই বাস্তব চিত্র সেই অধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নূরুল ইসলাম বলেন, “এটি কেবল অবকাঠামোগত সংকট নয়, এটি নীতিনির্ধারণের ব্যর্থতা। শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে শিক্ষা মান উন্নয়নের কথা বলা একধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা।” একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার শিক্ষার উপর। কিন্তু সেই শিক্ষা যদি কোমলমতি শিশুদের জন্য মৃত্যুঝুঁকির কারণ হয়, তবে সেটি কেবল মানবিক নয়, জাতীয় সংকটও বটে।
সচেতন নাগরিকরা মনে করেন, বরিশালের ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয়গুলোর সংস্কার এখনই শুরু করা না হলে যে কোনো সময় ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা, যার দায় এড়ানো কারো পক্ষে সম্ভব হবে না। শিক্ষা মানে শুধু বই আর খাতা নয় এটি নিরাপদ পরিবেশে বেড়ে ওঠার অধিকারও বটে। বরিশালের তিন শতাধিক বিদ্যালয়ের শিশুরা প্রতিদিন যে ঝুঁকি নিয়ে ক্লাস করছে, তা শুধু হৃদয়বিদারক নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি অন্যায়ও।