মির্জা রিমন ॥ সারাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক অগ্নিকাণ্ড ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় উদ্বেগ বিরাজ করছে তখন বরিশালেও দেখা দিয়েছে সম্ভাব্য নাশকতার শঙ্কা। রাজধানী থেকে শুরু করে বিভিন্ন জেলায় এসব ঘটনার পেছনে ‘নাশকতার উপাদান’ রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। কেন্দ্রীয়ভাবে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে বরিশাল অঞ্চলেও সম্ভাব্য নাশকতার ধাঁচ, উদ্দেশ্য ও কৌশল নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে প্রশাসন ও সাধারণ মানুষের মাঝে।
নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, বরিশালে নাশকতার আশঙ্কা মূলত তিন ধরণের কৌশলকে সামনে রেখে বিবেচনা করা হচ্ছে। সম্ভাব্য কৌশলগুলোর মধ্যে প্রথমটি হলো লক্ষ্যভিত্তিক অগ্নিসংযোগ। এ ক্ষেত্রে গভীর রাতে বস্তুনিষ্ঠভাবে নির্দিষ্ট স্থানে যেমন পরিবহন টার্মিনাল, লঞ্চ/বাস, বড়বাজার, গুদাম এবং রাজনৈতিক কার্যালয় হতে পারে প্রধান লক্ষ্যবস্তু। এ ধরনের হামলার লক্ষ্য থাকে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি, জরুরি সেবায় বিঘ্ন ঘটানো এবং নগরজীবন অচল করা এ কৌশলের লক্ষ্য বলে মনে করা হয়। দ্বিতীয়ত, সমন্বিত বিভ্রান্তিমূলক হামলা একই সময়ে দুটি বা ততোধিক স্থানে অগ্নিসংযোগ করে ফায়ার সার্ভিস ও নিরাপত্তাবাহিনীকে বিভ্রান্ত রাখা। এতে প্রধান লক্ষ্যবস্তুর দিকে প্রত্যাশিত সহায়তা বা উদ্ধারকার্য পৌছাতে বিলম্ব ঘটে এবং পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। নিরাপত্তা সূত্র বলছে, পূর্বপরিকল্পিতভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ, সিসিটিভি বা অন্যান্য নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটানোও এই কৌশলের অংশ হতে পারে। তৃতীয়ত, অবহেলা বা দুর্ঘটনা আড়াল করে নাশকতা চালানো পুরনো বাজার, নৌযানঘাট, গুদাম বা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের অগ্নি নিরাপত্তাহীনতাকে কাজে লিয়ে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগানো যাতে ‘দুর্ঘটনা’ বলে উপস্থাপন করা যায়। এ ধরণের ঘটনা সহজেই তদন্তকে বিভ্রান্ত করতে পারে এবং প্রাথমিকভাবে তা স্থানীয় অগনিত হতাহতের ঘটনা হিসেবেই ধরা পড়তে পারে।
এ বিষয়ে বরিশাল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সিনিয়র স্টেশন অফিসার রবিউল আল আমীন বলেন, “নগরীর গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায় আমরা নিয়মিত পরিদর্শন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। অগ্নিকাণ্ড মোকাবিলায় দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমাদের ফায়ারফাইটারদের প্রশিক্ষণও চলমান রয়েছে। পাশাপাশি আগামীকাল ২২ অক্টোবর বিভাগীয় সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অংশগ্রহণে কেমিক্যাল অগ্নিকাণ্ড ও দুর্ঘটনা ব্যবস্থাপনা বিষয়ক বিশেষ প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে যেকোনো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা সর্বদা প্রস্তুত আছি।”
বরিশাল রেঞ্জ পুলিশ ও জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক ঘটনার প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় নির্দেশনায় বাড়ানো হয়েছে রাত্রীকালীন টহল ও নজরদারি। ফায়ার সার্ভিসকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে এবং সব স্টেশনে জরুরি প্রতিক্রিয়ার ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। র্যাব, পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন। সিসিটিভি নেটওয়ার্ক ও ইলেকট্রনিক নজরদারির মাধ্যমে সন্দেহজনক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) বেলাল হোসাইন বলেন, “পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে দেশের সব ইউনিটকে সর্বোচ্চ সতর্কতায় থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে সে অনুযায়ী মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েছি। পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসকেও সবসময় প্রস্তুত থাকার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যেন যেকোনো পরিস্থিতিতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়। তবে এ নিয়ে নগরবাসীর উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমরা নিশ্চিত করছি, বরিশাল নগরীতে নাশকতা বা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বদা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এবং নগরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা বদ্ধপরিকর।”
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, জনসমাগম ও জরুরি পরিষেবাগুলোর কাছে পরিত্যক্ত ব্যাগ বা সন্দেহজনক ব্যক্তিকে দেখলে দ্রুত স্থানীয় পুলিশ বা ফায়ার সার্ভিসকে জানাতে অনুরোধ জানিয়েছেন। পাশাপাশি বাজার ও গুদাম মালিকদেরকে আগুন নির্বাপক যন্ত্র স্থাপন, বিকল্প প্রবেশপথ নিশ্চিতকরণ, নিয়মিত বিদ্যুৎ লাইন পরীক্ষা ও অগ্নি-নিয়ন্ত্রণ মহড়া চালুর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
এ বিষয়ে বরিশাল জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, বরিশালসহ সারাদেশে অগ্নিকাণ্ড-সংক্রান্ত আতঙ্কের এই সময়ে প্রশাসনের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সজাগ ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সময়মতো পদক্ষেপ ও সচেতনতা বড় ধরনের অনাকাক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে সহায়ক হতে পারে। নিরাপত্তা নিশ্চিত ও জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে এখন প্রয়োজন যৌথ দায়িত্বশীলতা ও স্বচ্ছ নিরাপত্তা ব্যবস্থা।