বেপরোয়া জেলেদের হামলায় অসহায় প্রশাসন

দেশ জনপদ ডেস্ক | ১৭:৪১, অক্টোবর ১৯ ২০২৫ মিনিট

বরিশালে সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ইলিশ শিকারে মহোৎসব চলছে। প্রশাসন ৪ অক্টোবর থেকে এই জাতীয় সম্পদ রক্ষায় ২২ দিনে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে নদীতে পাহারা বসালেও ইলিশ নিধন রোধ করতে পারছে না। বরং প্রতিনিয়ত জেলেদের ছোট-বড় হামলার শিকার হতে হচ্ছে, এতে প্রশাসনের শীর্ষসারির কর্মকর্তারা গুরুতর আহত হওয়ার খবরও রয়েছে। ইলিশ নিধনবিরোধী অভিযান চালাতে গিয়ে বারংবার অস্ত্রধারী জেলেদের হামলা প্রশাসনের এক ধরনের অসহায়ত্বের কথা জানান দিচ্ছে, যা নিয়ে স্থানীয় মৎস্য প্রশাসন নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গত ৪ অক্টোবর থেকে চলমান ইলিশ নিধনবিরোধী প্রশাসনের অভিযানিক টিমের ওপর বিভিন্ন স্থানে অর্ধশত হামলা হয়েছে। ট্রলার, স্পিডবোর্ট নিয়ে অভিযানে অংশ নিতে গেলে সংঙ্ঘবদ্ধ জেলেরা দূর থেকে ইট-পাথর ছুড়ে মারাসহ ধারালো অস্ত্রসমেত তেড়ে আসনে। সপ্তাহখানেকের ব্যবধানে হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ওপরও হামলার ঘটনা ঘটেছে। সূত্র জানায়, সর্বশেষ শনিবার সন্ধ্যার দিকে ইলিশের ষষ্ঠ অভয়াশ্রম হিসেবে পরিচিত বরিশাল জেলার হিজলা এবং মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলাসংলগ্ন মেঘনা নদীতে অভিযানিক টিমের ওপর হামলা হয়। এই হামলায় ভোলার এনডিসি, এসিল্যান্ড, মৎস্য কর্মকর্তাসহ অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, ভোলা জেলার এনডিসি তানজিবুল ইসলাম শনিবার বিকেলে কোস্টগার্ড এবং মৎস্য প্রশাসন নিয়ে ইলিশ নিধনবিরোধী অভিযানে অংশ নেন। একপর্যায়ে তাদের কাছে খবর ষষ্ঠ অভয়াশ্রমের আশেপাশে অন্তত অর্ধশত জেলে নৌকা নিয়ে ইলিশ নিধন করছেন। অভিযানিক টিম নিয়ে তিনি সেদিকে অগ্রসর হলে জেলেরা ইট-পাথর ছুড়ে মারতে থাকেন। এবং পর্যায়ে প্রশাসনের নৌযানটি জেলে ট্রলারের কাছাকাছি গেলে মৎস্যজীবীরা লাঠিসোটা নিয়ে হামলে পড়েন। এতে এনডিসিসহ অন্তত ১০ জন আহত হলে তাদের রাতেই উদ্ধার করে ভোলা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। এর আগে গত ০৭ অক্টোবর বরিশালের মেঘনা নদীতে মা ইলিশ রক্ষার অভিযানে জেলেদের হামলায় মৎস্য কর্মকর্তা ও কোস্টগার্ডের তিন সদস্য আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় হামলাকারী সাত জেলেকে আটক করা হয়। স্থানীয় আলীগঞ্জসংলগ্ন এলাকায় সেই হামলায় ঘটনায় একটি মামলাপরবর্তী সাত জেলেকে গ্রেপ্তারও করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই দুটি বড় সহিংসতার ঘটনায় ছাড়াও বরিশালে প্রশাসনের ওপর জেলেদের অসংখ্য হামলার খবর পাওয়া গেছে। এই হামলার কথা স্বীকার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, মৎস্য প্রশাসনের ডাকে সাড়া দিয়ে ইলিশ নিধন রোধে নদীতে নেমে জেলেদের কাছে এক ধরনের অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হচ্ছে। সারিবদ্ধভাবে জেলেরা জাল ফেলে ইলিশ শিকার করছে, তাদের রুখতে গেলে হামলার শিকার হতে হচ্ছে। এসময় নিজেদের কাছে থাকা অস্ত্রও আত্মরক্ষার্থে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে জেলেরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছেন, নিজেদের অসহায় মনে হচ্ছে। অভিযানে গিয়ে বারংবার জেলেদের হামলার ঘটনায় মৎস্য প্রশাসনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। জনবল এবং আধুনিক নৌযানসংকটের একটি বিষয় প্রকাশ্যে এসেছে। বিশেষ করে পটুয়াখালীর পায়রা নদীতে ইলিশ শিকার এবং সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গতিহীন একটি নৌযান নিয়ে হানা দেওয়ার একটি ভিডিও সমাজপাতায় রীতিমত আলোচনার ঝড় তুলেছে। ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, পায়রা নদীতে দিনের বেলা শত শত ইঞ্জিন সংযোজিত নৌকা নিয়ে জেলেরা ইলিশ শিকার করছেন। দুর্বল গতির একটি ইঞ্জিন চালিত ট্রলার নিয়ে সেখানে হানা দিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। কিন্তু নাগালে যাওয়ার আগেই জেলে নৌকাগুলো দ্রুতগতির ইঞ্জিন চালু দিয়ে স্থান ত্যাগ করে, যা নির্বাক হয়ে দেখেছেন কর্মকর্তারা। নদীতে প্রশাসনের এই অসহায়ত্ব নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। শুধু পটুয়াখালী নয়, বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের সবকটি জেলা মৎস্য প্রশাসনই নদীতে কচ্ছপের মতো নৌযান নিয়ে টহল দিচ্ছে, আর জেলেরা গতিসম্পন্ন নৌকা নিয়ে নির্ভয়ে ইলিশ শিকার করছেন। নৌযান সংকট এবং হামলার সম্ভব্য আশঙ্কা থাকলেও ইলিশ নিধন রোধে বরিশাল মৎস্য বিভাগ সর্বদা নদীতে সরব রয়েছে। জেলা মৎস্য অফিস সূত্র জানিয়েছে, ৪ অক্টোবর থেকে রোববার ১২ অক্টোবর পর্যন্ত দপ্তরটি ৩৬৬ টি অভিযানে অংশ নিয়েছে। পুলিশ, কোস্টগার্ড, আনসার এবং জেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে মোবাইল কোর্ট গঠন করে অভিযান চালানো হয়। এখন পর্যন্ত ১৩৬টি মোবাইল কোর্ট করে ২৪২ জনকে সাজা দেওয়াসহ ৫ লাখ ৮৬ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। এই কর্মকর্তা বলেন, অভিযান চালাতে গিয়ে এখন পর্যন্ত অর্ধশত স্থানে হামলার খবর পাওয়া গেছে। তবে দুটি বড় হামলা হয়েছে, একটি শনিবার সন্ধ্যার দিকে হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জসংলগ্ন অভয়াশ্রমে, অপরটি ০৭ অক্টোবর হিজলার আলীগঞ্জসংলগ্ন এলাকায়। এই দুটি সশস্ত্র হামলায় জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ অন্তত ২০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। বরিশালে জেলেদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হামলা প্রশাসনের মনে ভয় ধরিয়ে দেয় এবং তাদের নির্লুপ্ত করে তোলার করে। এই সুযোগে বরিশালের কীর্তনখোলা, তেঁতুলিয়া, কালাবদর এবং মেঘনাসহ বিভিন্ন নদীতে নিষেধাজ্ঞার সময়ে ইলিশ শিকারে মেতে উঠেছে জেলেরা। প্রশাসন কি ভয়ে অসাধু জেলেদের কাছে নতি স্বীকার করল? এমন প্রশ্নের উত্তরে মৎস্য অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগের উপ-পরিচালক কামরুল ইসলাম বলেন, লোকবলের পাশাপাশি আধুনিক নৌযান সংকট তাদের ভোগাচ্ছে। তাছাড়া এক শ্রেণির জেলেরা আইন মানতে চাইছেন না। এমনকি নিষেধাজ্ঞার সময়ে তাদের চালসহ সহযোগিতা করেও ঘরে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে মৌসুমি জেলেরাও সক্রিয় হয়েছেন। তাদের রুখতে গিয়ে নদীতে একাধিকবার প্রশাসন আঘাতপ্রাপ্ত হতে হচ্ছে। নদীতে প্রশাসন যে কতুটুক অসহায় তা এই কর্মকর্তার কথাও অনুমান করা যায়। ফলে এবারের মৌসুম ইলিশ প্রজননে সরকার কতটা সফল হবে তা নিয়েও থেকে যাচ্ছে সংশয়।’