ডিসি লেকের উন্নয়ন বন্ধে শিশুদের ব্যবহার করে আন্দোলন
নিজেস্ব প্রতিবেদক|০১:১৪, অক্টোবর ০৭ ২০২৫ মিনিট
মির্জা রিমন ॥ বরিশাল শহরের প্রানকেন্দ্রে অবস্থিত ঐতিহাসিক ডিসি লেক কেবল একটি প্রাকৃতিক জলাধার নয়, এটি বরিশালের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও নগরবাসীর আবেগের গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। দীর্ঘদিন ধরে এই লেক নগরবাসীর বিনোদন, প্রশান্তি ও সামাজিক মিলনমেলার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রশাসনিক এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় এটি শুধু বিনোদনের নয়, বরং নিরাপত্তার দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল। সাম্প্রতিক সময়ে এই লেকের সৌন্দর্য ও নিরাপত্তা রক্ষায় একটি সুনির্বাচিত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসন। অথচ দুঃখজনকভাবে কিছু বামপন্থী রাজনৈতিক গোষ্ঠী বিষয়টিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।
বিশেষ করে শিশুদের ব্যবহার করে আন্দোলনের চেষ্টা, নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতার প্রশ্ন উঠেছে নগরজুড়ে। শিশুদের ব্যবহার করে আন্দোলন চালানো এবং চিত্রাঙ্কন কর্মসূচির সময় দুজন শিশুর পানিতে পড়ে যাওয়ার ঘটনা জনমনে উদ্বেগ ও ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। প্রকৃতপক্ষে, ডিসি লেককে সৌন্দর্যহীন কোনো কাঠামোয় আবদ্ধ করা হচ্ছে না। নির্মিতব্য প্রাচীরটি আধা ইটের গাথুনি ও আধা গ্রীল দিয়ে তৈরি হচ্ছে। যা সম্পূর্ণ আধুনিক, দৃষ্টিনন্দন এবং জনবান্ধব। কোমর সমান উঁচু দেয়ালের উপরে শোভনীয় লোহার গ্রিল থাকায় ভেতরের দৃশ্য পুরোপুরি উন্মুক্ত থাকছে। এমন নকশা শুধু দৃষ্টিনন্দন নয়, বরং নিরাপত্তা ও সৌন্দর্যের মাঝে এক ভারসাম্য তৈরি করেছে। এতে লেকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন অক্ষুন্ন থাকবে, তেমনি নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে। প্রাচীর নির্মাণের ফলে জনসাধারণের চলাচলে কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না। বরং লেক ঘিরে নির্মিত ওয়াকওয়েটি থাকবে প্রাচীরের বাইরের অংশে, যা হেঁটে চলার উপযোগী এবং নিরাপদ। এটি থাকবে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। এমন ব্যবস্থায় নারী, শিশু ও বৃদ্ধ পথচারীরাও নিশ্চিন্তে সময় কাটানো পাশাপাশি ভেতরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। এটা একেবারেই মিথ্যা যে লেক ‘আবদ্ধ’ হয়ে যাচ্ছে বা জনসাধারণ বঞ্চিত হচ্ছে।
এদিকে দীর্ঘদিন ধরেই কিছু তরুণ-তরুণী লেকের পাশে গভীর রাত পর্যন্ত সময় কাটানোর নামে অসামাজিক কার্যকলাপ করেন। পাশের সড়ক দিয়ে যাতায়াতকারীদের বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। তাছাড়া এখানে মাদকসেবীদের আড্ডা এবং লেক থেকে মাছ চুরিসহ ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটছে। এছাড়াও সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বাসভবন লেকের আশেপাশে হওয়ায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও প্রশাসনের দায়িত্ব। এই কারণেই সীমানা প্রাচীর নির্মাণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
এটাই প্রথমবার নয় যে বরিশালে কোনো লেক বা পুকুরের চারপাশে প্রাচীর নির্মাণ করা হচ্ছে। পরেশ সাগর, বিবির পুকুর ও জেলা পরিষদ পুকুর সবগুলোতেই সৌন্দর্য রক্ষায় এবং নিরাপত্তার স্বার্থে প্রাচীর বা রেলিং তৈরি করা হয়েছে। সেখানে কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের তেমন কোনো বিরোধিতা দেখা যায়নি। আর এরাই এখন সরব হয়েছে ডিসি লেকের প্রাচীর নির্মান বন্ধের জন্য। একের পর এক বিভিন্ন প্রতিবাদী কর্মসূচীর আয়োজন করলেও নগরবাসীর সাড়া না মেলায় সর্বশেষ আইনের আশ্রয় পর্যন্ত নিয়েছেন।
এ নিয়ে মামলা দায়ের করেছেন তরুণ আইনজীবী এবং জেলা (দক্ষিণ) যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট হাফিজ আহমেদ খান বাবলু। গত মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) তিনি বরিশাল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ মামলা দায়ের করেন। শুনানি শেষে আদালতের বিচারক মো. সাদিক আহমেদ বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কোতয়ালী মডেল থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছেন। মামলায় অজ্ঞাত নির্দেশদাতা, ঠিকাদার এবং আরও কিছু অজ্ঞাত ব্যক্তিকে বিবাদী করা হয়েছে। যদিও এই প্রকল্পটি জনস্বার্থে গৃহীত, তথাপি একজন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃস্থানীয় আইনজীবী মামলা দায়ের করায় জেলা প্রশাসন যথাযথভাবে আদালতের নির্দেশনা অনুসরণ করে পুরো উন্নয়নমুলক কাজটি সাময়িক বন্ধ করে দিয়েছে।
এনিয়ে বরিশাল জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, “দৃষ্টিনন্দন লেক গড়তে চাই, জোর করে কিছু চাপিয়ে দিতে নয়”। “আমি লেকের পাশে কোনো প্রাচীর নির্মাণ করছি না। বরং নিচু করে একটি নিরাপত্তা বেষ্টনি নির্মাণ করা হচ্ছে, যার ওপর গ্রিল বসিয়ে পুরো বিষয়টিকে দৃষ্টিনন্দনভাবে উপস্থাপন করার পরিকল্পনা করেছি। মূল উদ্দেশ্য বরিশালবাসীকে একটি সুন্দর, নিরাপদ ও আধুনিক লেক উপহার দেওয়া।” জেলা প্রশাসক আরও জানান, “লেকের মধ্যে আলোকসজ্জা ও পানির ফোয়ারার মাধ্যমে পুরো পরিবেশকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। যাতে পরিবার, শিশু ও তরুণ-তরুণীরা নির্বিঘ্নে এখানে সময় কাটাতে পারে। এটি হবে বরিশালের মানুষের জন্য একটি উন্মুক্ত ও নিরাপদ বিনোদন কেন্দ্র।” তবে সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে আদালতে মামলা হওয়ায় কাজটি আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।
এ সময় তিনি অনেকটা দাবী নিয়ে জানান, আমি এখানে জোর করে কিছু চাপিয়ে দিতে আসিনি। বরং বরিশালবাসী যদি প্রকল্পটি চান, তাহলে আমরা নিরাপত্তার দিকটি নিশ্চিত করে কাজটি এগিয়ে নেব। আর যদি না চান, তাহলে সেটিও শ্রদ্ধার সাথে বিবেচনায় নেওয়া হবে।”
সম্প্রতি ডিসি লেকের উন্নয়নের বিরুদ্ধে একটি বামপন্থী সংগঠন শিশুদের ব্যবহার করেও আন্দোলনের চেষ্টা করেছেন। যা নৈতিকতার প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে নগরবাসীকে। চিত্রাঙ্কন কর্মসূচির আয়োজনের সময় দুজন শিশু পানিতে পড়ে যায়। এটি কেবল দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ নয়, বরং শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে চরম উদাসীনতার নজির। প্রশাসনের উন্নয়নমূলক পরিকল্পনার বিপরীতে এই ধরনের আবেগনির্ভর প্রতিবাদ কার্যক্রম বাস্তবতা ও যৌক্তিকতা থেকে অনেক দূরে।
এ বিষয়ে নগরীর ১০ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা আশীক এলাহি তুহিন বলেন, বরিশালের ডিসি লেক শুধু একটি জলাধার নয়, এটি নগরবাসীর গর্ব। এই গর্ব রক্ষা করতে গেলে পরিকল্পিত ও সময়োপযোগী উন্নয়ন প্রয়োজন। কুচক্রীমহলের অপপ্রচারে কান না দিয়ে সকলকে প্রকৃত চিত্রটি অনুধাবন করার অনুরোধ রইল। তবে লেকের পাশে প্রাচীর নির্মান আমলাতান্ত্রিক দখল সত্ত্বের নজির বলে অ্যাখ্যা দিয়েছেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) বরিশাল জেলা শাখার সমন্বয়ক মনীষা চক্রবর্তী। তিনি বলেন, নিরাপত্তার অযুহাতে প্রাচীর নির্মান আসলে আমলাতান্ত্রিক দখল সত্বের নজির স্থাপিত হচ্ছে। যে রকমটা আমরা পরেশ সাগর পুকুরে প্রাচীর নির্মাণের ক্ষেত্রে দেখেছি।
তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন’র (বাপা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী ও সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) বরিশাল জেলার সাধারন সম্পাদক রফিকুল আলম জানিয়েছেন ভিন্নমত। তিনি জানান, জলাশয়টির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য নষ্ট না করে জনসাধারনের কাছে উপভোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে। সাথে সাথে জলাশয়টির চারপাশে গাইড ওয়াল নির্মান করাও জরুরী।
তবে এ ধরনের আন্দোলনে শিশুদের অংশগ্রহন উচিত নয় জানিয়ে তিনি আরো বলেন, শিশুরা সমাজের ভবিষ্যৎ। তাদের নিরাপত্তা, সুস্থ মানসিক বিকাশ এবং নিরপেক্ষ পরিবেশে বড় হওয়া নিশ্চিত করা সবার দায়িত্ব। কোনো রাজনৈতিক বার্তা পৌঁছাতে গিয়ে শিশুদের এমন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে ঠেলে দেওয়া যেমন অগ্রহণযোগ্য, তেমনি সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাবও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।