নিজস্ব প্রতিবেদক : বরিশাল সিটি করপোরেশনের স্টল বরাদ্দ নিয়ে রমরমা ভাড়াবাণিজ্য চালাচ্ছেন স্টল মালিকরা। অভিযোগ রয়েছে, বরিশাল নগরীর ১২টি মার্কেটের ১ হাজার ৬৫০টি স্টলের প্রায় সবই চলে গেছে জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীদের হাতে। শুধু তাই নয়, খোদ বরিশাল সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের হাতেও গেছে স্টলের বরাদ্দ। বরিশাল সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীদের হাতে স্টলের বরাদ্দ কুক্ষিগত হলেও শত চেষ্টা করেও স্টলের বরাদ্দ না পেয়ে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রকৃত ব্যবসায়ীরা।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের আয় বৃদ্ধির অন্যতম খাত বিভিন্ন মার্কেটের স্টল। এ সব স্টল বরাদ্দ নিয়ে একটি চক্র লাভবান হলেও কর্তৃপক্ষের হাত থেকে যাচ্ছে শূন্য। নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে স্টল মালিকদের হাতে বড় অঙ্কের টাকা তুলে দিয়ে ব্যবসা চালাতে হচ্ছে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের। পজিশন বাবদ তাদের গুনতে হচ্ছে স্টলপ্রতি অন্তত ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা। পাশাপাশি মাসিক ভাড়া গুনতে হচ্ছে ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। এতে বিপুল অঙ্কের টাকা লেনদেন হলেও এর ছিটেফোঁটাও পাচ্ছে না বরিশাল সিটি করপোরেশন। তাদের হাত শূন্যই থেকে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন প্রকৃত ব্যবসায়ীরা। তারা জনপ্রতিনিধি, বিসিসির কর্মকর্তা-কর্মচারী ও প্রভাবশালীদের ক্ষমতার দাপটের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছেন। শত চেষ্টার পরও কোনোভাবেই স্টল বরাদ্দ পাচ্ছেন না তারা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বরিশাল সিটি করপোরেশনের আয় বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় এই ক্ষেত্রটিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সর্বোচ্চ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে আশ্বস্ত করেছেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রেজাউল বারী। তার মতে, শর্ত ভঙ্গকারীদের চুক্তি প্রয়োজনে বাতিল করা হবে। দ্রুত বিষয়টি জরুরি সভায় তুলে ধরা হবে এবং প্রকৃত ব্যবসায়ীদের জন্য বাজার নিশ্চিত করা হবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রেজাউল বারী বলেন, আমরা ইজারা এবং মাসিক ভাড়ায় বাজার ও স্টল বরাদ্দ দিয়ে থাকি। এ ক্ষেত্রে কেউ নিজ স্টল অন্যের কাছে ভাড়া দেওয়ার শর্ত ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, এছাড়া প্রতি তিন বছর পরপর বাজার মূল্যায়ন করে ভাড়ার পরিমাণ হালনাগাদ করা হবে। বর্তমানে বরিশাল সিটি করপোরেশন এসব স্টল থেকে মাসে সর্বনিম্ন মাত্র ৫২৭ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৭২৫ টাকা করে ভাড়া পাচ্ছে বলেও জানান বরিশাল সিটি করপোরেশনের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
এদিকে বরিশাল সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার মতে, এতদিন কর্তৃপক্ষীয় নির্দেশনা না থাকায় এমন অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে জানার জন্য যোগাযোগ করা হলে বরিশাল সিটি করপোরেশনের হাট-বাজার ও স্টল পরিদর্শক এস এম আবুল কালাম বলেন, নিয়মে বলা আছে সাবলেটের কথা। তবে অবশ্যই তা নিয়ম মেনে করতে হবে। সাবলেট দেওয়ার আগে অবশ্যই বিসিসি কর্তৃপক্ষকে নির্দিষ্ট অঙ্কের ফি দিয়ে অনুমতি নিতে হবে। অথচ অনুমতি নিতে কখনোই কেউই আসে না আমাদের কাছে। এমন অচলাবস্থা পৌরসভা যাত্রা শুরু করার পর থেকেই চলে আসছে।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের হাট-বাজার ও স্টল পরিদর্শক এস এম আবুল কালাম আরও বলেন, আগে কোনো নীতিমালা ছিল না। পরবর্তী সময়ে নীতিমালা হলেও তা কোনোভাবেই বাস্তবায়ন করতে পারছি না কর্তৃপক্ষের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার অভাবে। সাবেক এক মেয়র ভাড়া দ্বিগুণ করলে ওরা আন্দোলন করে তা বন্ধ করে দেয়। এখন অবশ্য রাজনৈতিক প্রভাব নেই। এখন কর্তৃপক্ষ নির্দেশনা দিলে আমরা নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে পারব বলে আশা রাখি।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশাল নগরীর সর্ববৃহৎ ফজলুল হক এভিনিউ মার্কেটে বরিশাল সিটি করপোরেশনের স্টল সংখ্যা ২৭৩টি। এসব স্টলবাবদ বিসিসির মাসিক আয় তিন লাখ টাকা। একইভাবে সদর রোড মার্কেট, মেডিকেল মার্কেট, মিউনিসিপাল মার্কেটসহ মোট ১২টি মার্কেটের ১ হাজার ৬৫০টি স্টল থেকে বছরে মাত্র তিন কোটি টাকা আয় করছে বরিশাল সিটি করপোরেশন। কিন্তু বরিশাল নগরীতে বসবাসকারী প্রকৃত ব্যবসায়ীদের কখনোই ১২টি মার্কেটের ১ হাজার ৬৫০টি স্টল থেকে একটি স্টলও বরাদ্দ প্রদান করা হয়নি। তারা চড়া দামে পজিশন ও ভাড়া গুনে ব্যবসা করতে বাধ্য হচ্ছেন। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে দ্রব্যমূল্যের ওপর। ইচ্ছা থাকলেও সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা।
কথা হয়-বই ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে। এ সময় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অনেক বছর ধরে আমি এই দোকানে বইয়ের ব্যবসা করছি। এখন পর্যন্ত অনেকবার পৌরসভা ও বিসিসিতে একটি স্টল চেয়ে আবেদন করেছি, কিন্তু পাইনি। না পাওয়ার পেছনের কারণ হলো, এসব স্টল আত্মীয়স্বজনকে অথবা লেনদেনের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। সামর্থ্য নেই বলে আমাদের কপালে জোটেনি কোনো স্টল। এখানে আমরা পজিশন বাবদ ২০ লাখ টাকার পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা মাসিক ভাড়া দিয়ে ব্যবসা করছি। প্রকৃত ব্যবসায়ীদের কেউই স্টল পাননি বলেও জানান বই ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন।
স্টল বরাদ্দ নিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ৯১ টাকা বর্গফুট হিসেবে ভাড়া আদায় করছে অসাধুরা। অথচ বিসিসি ভাড়া পাচ্ছে প্রতি বর্গফুটে মাত্র ৬ টাকা। আর তাই অন্য বাণিজ্যিক মার্কেটগুলো লাভ করলেও বরিশাল সিটি করপোরেশনের খাতা থাকছে শূন্য। স্টল মালিকরা এসব স্টল দিয়ে কোটি কোটি টাকা আয় করে নিয়ে যাচ্ছেন সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে। প্রকৃত ব্যবসায়ীরা স্টলের বরাদ্দ না পাওয়ায় স্টল মালিকদের পজিশন ও ভাড়া বাবদ বড় অঙ্কের টাকা দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা দাবি তুলেছেন, ট্রেড লাইসেন্স দেখে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হোক।
ঝাউতলা স্টলের একজন ব্যবসায়ী বলেন, এখানে ৫ বছর যাবত ব্যবসা করছি। স্টল মালিককে অগ্রিম ৬ লাখ টাকা এবং মাসিক ১৬ হাজার ১০০ টাকা দিয়ে আমি ব্যবসা করছি। অথচ ট্রেড লাইসেন্স আমার। অগ্রিম টাকা ও ভাড়ার ব্যয় মেটাতে পণ্য বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। স্টল আমার নামে থাকলে পণ্যের দামও কমত। আরেক ব্যবসায়ী বলেন, এই স্টলের প্রকৃত মালিকের কাছ থেকে আমি স্টল কিনে নিয়েছি এবং বিসিসিকে জানিয়েছি। বিসিসিকে প্রতি মাসে ১ হাজার ৬৭ টাকা ভাড়া দেই। অন্য ব্যবসায়ী বলেন, বিসিসির স্টল পাচ্ছে আত্মীয়স্বজনরা।
স্টল মালিকরা একের পর এক হাত বদল করে চড়ামূল্যে ভাড়া দিচ্ছে। আমাদের দাবি, প্রকৃত ব্যবসায়ীদের ট্রেড লাইসেন্স দখে যেন স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়। বরিশাল সিটি করপোরেশনের স্টলের নাম বদল করে ব্যবসা করা সম্পূর্ণ বেআইনি। নিয়ম হলো নাম বদল করে ব্যবসা করতে হলে দুই বছরের ভাড়ার সমপরিমাণ টাকা নতুন করে জমা দিয়ে তা করতে হবে। এখন পর্যন্ত নামমাত্র কয়েকজন এমনটা করেছেন। যদি নাম বদলের নিয়মটাও মানা হতো তাহলেও বরিশাল সিটি করপোরেশন এ বাবদ কয়েক কোটি টাকা আয় করতে পারত।