বানারীপাড়ায় ৬ মাস ধরে খোলা আকাশের নিচে ৩১টি হতদরিদ্র পরিবারের মানবেতর জীবন!
দেশ জনপদ ডেস্ক|২১:৪৮, জুন ১৩ ২০২৫ মিনিট
‘দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫৪ বছর, কিন্তু প্রান্তিক মানুষের ভাগ্যের স্বাধীনতা এখনো আসেনি’ এরই যেন বাস্তব এক প্রতিচ্ছবি বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার খেজুরবাড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৩১টি ভূমিহীন পরিবারের। ২০২৩ সালের ২২ মার্চ, তৎকালীণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় বরিশালের বানারীপাড়াকে ‘ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত’ ঘোষণা করা হয়। সেই ঘোষণার দেড় বছরের মাথায় ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যার দিকে পূর্বের কোনো নোটিশ ছাড়াই উপজেলার সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের খেজুরবাড়ি আবাসনে উচ্ছেদ অভিযানে নামে বানারীপাড়া উপজেলা প্রশাসন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট মো. বায়েজিদুর রহমান এ অভিযানের নেতৃত্ব দেন।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বায়েজিদুর রহমান জানান, আবাসনের ওই ৩১টি পরিবার দীর্ঘদিন ধরে বৈধ দলিল ছাড়াই সরকারি ঘরগুলো দখল করে বসবাস করেছে। তারা যে মালিকানা দাবি করে দলিল দেখাচ্ছে, তা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। এর আগেও তাদের একাধিকবার ঘর ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তারা তা মানেনি। ফলে উপজেলা প্রশাসন বাধ্য হয়ে এসব ঘরে তালা লাগানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং তা বাস্তবায়ন করে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, কোনো ধরনের পূর্ব ঘোষণা বা লিখিত নোটিশ ছাড়াই খেজুরবাড়ি আবাসনের ৩১টি পরিবারকে হঠাৎ করে ঘর থেকে বের করে দিয়ে তালা লাগিয়ে দেয় উপজেলা প্রশাসন। ঘরের ভেতরে রয়ে যায় ওইসব পরিবারের সদস্যদের খাবার, কাপড়-চোপড়, এমনকি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্রও। কোথাও একটু থাকার জায়গার ঠাঁই না পাওয়ায় বিগত ছয়টি মাস এসব হতদরিদ্র পরিবার তালাবদ্ধ আশ্রয়নের ঘরের সামনে পলি-খড় দিয়ে বেড়া দিয়ে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। ঝড়, বৃষ্টি বা বন্যা-জলোচ্ছ্বাসের মধ্যেও ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে এই দুঃসহ জীবনযাপন এখন তাদের নিত্যদিনের করুন বাস্তবতা। ভুক্তভোগীরা বলেন, “আমরা তো অশিক্ষিত মানুষ। যখন ঘরের জন্য আবেদন করেছিলাম, তখন আমাদের একটি সাদা কাগজে ‘স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতিপত্র’ দেয়া হয়েছিল, যেখানে তৎকালীন ইউএনও ও চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর ছিল। আমরা ভেবেছিলাম এটাই বুঝি আমাদের মালিকানা দলিল। এখন প্রশাসন বলছে এই কাগজ অগ্রহণযোগ্য।” তারপরেও ইউএনও জানিয়েছিলেন, যাদের কাছে বৈধ দলিল নেই, কিন্তু যাওয়ারও কোনো জায়গা নেই তাদেরকে তদন্ত করে অতিদ্রুত পুনর্বাসনের আওতায় আনা হবে। আর যাদের অন্যত্র জমি বা ঘর আছে, তারা পুনর্বাসনের যোগ্য বিবেচিত হবেন না।” তবে ছয়টি মাস পেরিয়ে গেলেও সেই কথা আর বাস্তবে প্রতিফলিত হয়নি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে উচ্ছেদের পর এখন পর্যন্ত আর কোনো খোঁজখবর নেয়া হয়নি বলেই অভিযোগ এ সমস্ত ভুক্তভোগীদের।
ভুক্তভোগীরা আরো জানান, ‘আমরা এখানে ১৫-১৬ বছর ধরে বাস করছি। তখন আমাদের বাড়িঘর সন্ধ্যা নদীতে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় খেজুরবাড়ি আশ্রয়ণে কিছু ঘর খালি থাকায়, তৎকালীন ইউএনও এবং ইউপি চেয়ারম্যান স্থানীয়ভাবে যাচাই-বাছাই করে আমাদের আবেদন নিয়ে সেসব ঘরে থাকতে দেন। তখন খালি ঘরের দাবিদারদের বারবার নোটিশ দিয়েও সাড়া না পাওয়ায় আমাদের ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়। এসব ঘরের বৈদ্যুতিক সংযোগ ও কর প্রদান ইত্যাদির কাগজসমূহে আমাদের নামসহ এলাকার নাগরিক হিসেবে ভোটার আইডি কার্ড পর্যন্ত করা হয়েছে। বহুবছর যাবৎ শিশুদের স্কুল-মাদরাসায় লেখাপড়া চলছে এখানেই। এমন বাস্তবতার পরেও উপজেলা প্রশাসনের এ আচরণ সত্যিই দুঃখজনক ও অমানবিক। ‘দেড় দশকেরও অধিক সময় ধরে বসবাসের পরেও এখন তাদের বসবাস অবৈধ বলে ঘোষণা করা হচ্ছে। মানবিক দিক বিবেচনা করে প্রশাসনের এই আচরণকে দায়িত্বহীন ও অমানবিক বলেই মনে করছেন স্থানীয় সচেতনমহল। সরকারের ঘোষণা ছিল ‘দেশে একজন মানুষও ভূমিহীন ও গৃহহীন থাকবে না’। অথচ বানারীপাড়ার খেজুরবাড়িতেই সেই ঘোষণার বিপরীত চিত্র চোখে পড়ে। ৩১টি পরিবার এখনো মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে তালাবদ্ধ ঘরের সামনের খোলা আকাশের নিচে। ভূক্তভোগীরা অবিলম্বে তাদের স্থায়ী পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছেন।