নিজস্ব প্রতিবেদক : শৈশব শেষের আগেই অধিকারবঞ্চিত অনেক শিশুর জীবন সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, সামাজিক বৈষম্য আর নানামুখী বাধায় তাদের শিক্ষাজীবন থমকে যায় মাঝপথে।
এমন বাস্তবতায় এই শিশুদের ঝরে পড়া ঠেকাতে এগিয়ে এসেছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণ-তরুণী। ‘পদাতিক’ নামের একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের ব্যানারে তাঁরা চালু করেছেন সাপ্তাহিক পাঠদান কর্মসূচি ‘আমরা করব জয়’।
নগরের কীর্তনখোলা নদীতীরের চাঁনমারি এলাকায় কলোনিতে (বস্তি) এই পাঠশালার সূচনা। শতাধিক শিশুকে নিয়মিত পাঠদান করাছেন তাঁরা। এখানে শুধু পাঠ্যবইয়ের মধ্যে এই পাঠ সীমাবদ্ধ নয়, শিশুদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহী ও আনন্দময় করতে শেখানো হয় গান, কবিতা ও গল্প। গান, গল্প, কবিতা বলার মাধ্যমে চলে পাঠদান।
প্রতি সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার বেলা তিনটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে ‘আমরা করব জয়’ পাঠশালার এই ব্যতিক্রমী পাঠদান কার্যক্রম। শিশুদের হাতে তুলে দেওয়া হয় প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ, যা সংগঠনের সদস্যরা নিজেদের হাত খরচ বাঁচিয়ে সংগ্রহ করেছেন।
পদাতিকের সভাপতি ভূমিকা সরকার বললেন, ‘আমরা স্বপ্ন দেখি একটি সমৃদ্ধ দেশের। সুনাগরিকের শান্তিময় দেশ। এ জন্য সবার আগের সব মানুষের শিক্ষা প্রয়োজন। কিন্তু সামাজিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক দৈন্য, অজ্ঞতা আমাদের শিশুদের সেই অধিকার নিশ্চিতের পথে বড় প্রতিবন্ধক। কিন্তু আমরা যারা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছি, তারা যদি যে যার জায়গা থেকে এই অন্ধকার উত্তরণে সামান্য ভূমিকা নিই, তাহলে ছোট এই উদ্যোগে দেশটা আলোয় আলোকিত হতে পারে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থীর এমন উদ্যোগে আশা জেগেছে এই কলোনির বাসিন্দাদের মধ্যে। তাঁরা অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে কঠিন জীবনসংগ্রাম করছেন। এ দিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ করতেই দম আটকে যাওয়ার অবস্থা। তাই বাধ্য হয়ে অনেকেই শিশুদের পড়ালেখার ব্যয় বহন করতে না পেরে তাদের কাজে পাঠান। এভাবেই শিক্ষাক্ষেত্র থেকে ঝরে পড়ছে নিম্নবিত্তের এই শিশুরা।
শনিবার বিকেলে কীর্তনখোলার তীরে শিশুদের এই পাঠশালায় গিয়ে দেখা যায়, খোলা জায়গায় ত্রিপল বিছিয়ে শিশুদের পাঠদান করাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী। একপর্যায়ে গিটার হাতে একজন শিক্ষার্থী গান তুলছেন, ‘আমরা করব জয়, আমরা করব জয়…।’ শিশুরাও তাঁর গলায় গলা মিলিয়ে কোরাস গাইছিল।
লামিয়ার বয়স সাত বছর। শিশুটি জানাল, ‘এইহানে পড়তে আমার খুব ভালো লাগে।’ ১৫ বছর বয়সী সাকিব বলল, ‘আমরা গরিব, খান-পড়নেই কষ্ট। হেইতে পড়াল্যাহা ছাইড়্যা দিছিলাম। এহন এই পাঠশালায় আবার শুরু করছি। খুব আনন্দ অয় এইহানে পড়তে আইলে। যদি এইডা সপ্তাহে চাইর বা পাঁচ দিন অইতো, তাইলে আমাগো ভালো অইতো।’ একই কথা জানায় তার সমবয়সী আরেক কিশোর রিফাত।
কলোনির বাসিন্দা ও এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক মনোয়ারা বেগম বললেন, ‘আমাগো তো কাম কইর্যা পেট চালান লাগে। পোলাপান পড়ামু হেই জোত্তর তো নাই। হেইতে অনেক বাচ্চা অল্প বয়সে স্কুলে যাওন ছাইড়্যা দেয়, কামে-কাইজে পাঠায়।
ছাত্রছাত্রীরা এহন এই স্কুল খোলনে আমাগো অনেক উপকার অইছে। পড়ানে কোনো খরচ অয় না। পোলাপানও আনন্দের মধ্যে পড়াশুনা করে, পড়নের আগ্রহ বাড়ছে। অ্যাতে অনেক শিশুর ভবিষ্যৎ বদলাইবে।’ অভিভাবক জান্নাত আকতার, জাহানারা বেগমও এই উদ্যোগে খুশি আর স্বস্তির কথা জানান।
পদাতিকের সদস্যরা জানিয়েছেন, আপাতত সপ্তাহে দুই দিন পাঠদান হলেও ভবিষ্যতে যদি সহায়তা মেলে, তাহলে তাঁরা সপ্তাহের অধিকাংশ দিনই ক্লাস পরিচালনার পরিকল্পনা করছেন। পাশাপাশি শিশুরা যেন মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায় আবারও যুক্ত হতে পারে, সেই লক্ষ্যে বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজনের কথা ভাবছেন তাঁরা।
পদাতিকের স্বেচ্ছাসেবার এ কাজের বিষয়ে বরিশাল জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ পারভেজ বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের এ উদ্যোগের বিষয়ে আমি আগেই জেনেছি। একটি পাঠদান অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। এটি অবশ্যই একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। পড়াশোনার পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবার চর্চা আমরা যত বাড়াব, তত বেশি মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন প্রজন্ম আমরা পাব। একটি দেশের উন্নতির জন্য এই মানুষ অপরিহার্য।’