বরিশালে ভুয়া রশিদে এতিমখানার নামে চাঁদা নাকি ধোঁকাবাজি!

দেশ জনপদ ডেস্ক | ২১:২২, ফেব্রুয়ারি ২৫ ২০২৫ মিনিট

নিজস্ব প্রতিবেদক : বরিশালে বেড়েই চলছে পাড়া মহল্লা, রাস্তা ঘাট কিংবা গণপরিবহণ থেকে মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানার নামে চাঁদা আদায়। মাদ্রাসা ও এতিমখানার অস্তিত্ব না থাকলেও ব্যয় নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। বরিশাল নগরীর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পয়েন্টে মসজিদ-মাদ্রাসার জন্য এভাবেই চাঁদা তুলছে কয়েকটি চক্র। পাশাপাশি মাইকে বিভিন্ন ধর্মীয় বাণী প্রচারের মাধ্যমে পথচারীদের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টাও চলছে। আবার রশিদ হাতে ধরিয়ে দিয়ে এতিমখানা বা লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের নামেও তোলা হচ্ছে অর্থ। তবে এধরণের বেশকিছু এতিমখানায় গিয়ে দেখা গেলো ভিন্ন চিত্র। ছোট দুই কামরার বাসা ভাড়া নিয়ে কয়েকটি শিশুকে দ্বীনি শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। তবে এতিম শিশু মাত্র দুটি। কেউ কেউ আবার মাসিক বেতন দিয়ে পড়তে আসে। বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় অনেকেই বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চান। তবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামে চাঁদাবাজি নিয়ে ইসলাম আসলে কি বলছে? আর এসব ক্ষেত্রে আইনশৃংখলা বাহিনীরও কি ভুমিকা কি আদৌ আছে? দান খয়রাতের বিষয়ে ইসলাম ধর্ম উৎসাহিত করে এটা যেমন ঠিক তেমনি প্রয়োজন যথাযথ নজরদারিও। এছাড়া প্রতারক চক্রের কারণে হুমকির মুখে মুসলমান সন্তানদের সঠিকভাবে তা’লীম তরবিয়াতের মাধ্যমে হিফাযত করা অর্থাৎ ইলম ও আমল শিখানো নগরীর মাদ্রাসা গুলো। ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে, এভাবে চাঁদা তুলে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা শরীয়ত সম্মত নয়। দেখা গেছে, মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি আর সরল বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে, নাম পরিচয়হীন এতিমখানার নামে চাঁদাবাজী করছে এক শ্রেণীর মানুষ। এভাবেই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রতিদিন জাহাঙ্গীর ও রিফাতসহ একাধিক চক্র হাতিয়ে নেয় এতিমখানার নামে অর্থ। সমাজের মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে পুঁজি করে জমজমাট ব্যবসা করছে এই সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র গুলো। নিজেদের আলেম দাবি করে এই প্রতারক চক্র ছড়িয়ে আছে বরিশাল শহর সহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে। জাহাঙ্গীর রিফাত রায়হানসহ একাধিক প্রতারক চক্রেরই সন্ধান মিলেছে বরিশাল নগরীতে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বরিশাল শহর যেখানে প্রতিদিন-ই যাতায়াত করেন লাখো মানুষ। কেউ পথচারী, কেউবা বিনোদনের আশায়। এসব আগন্তুকদের ঘিরে গড়ে উঠেছে এতিমের নামে টাকা আদায়কারী কয়েকটি সিন্ডিকেট। এদের উৎপাতে চরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছেন পথচারীরা। বিরক্ত পথচারীদের কেউ কেউ এটিকে এতিমদের সাহায্যার্থে ভিক্ষাবৃত্তির নামে এক ধরনের ব্যবসা হিসেবে দেখছেন। কেউ সন্দেহ ভরা মনে এড়িয়ে চলছেন। কেউ আবার সাত-পাঁচ না ভেবেই সওয়াবের আশায় কিংবা সম্মান রক্ষায় দানও করছেন। তবে অভিযোগের সুরে অনেকেই বলছেন, রাস্তার মাঝে এভাবে টাকা আদায় বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বা প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। নগরীর ব্রাউন কম্পাউন্ড এলাকার বাসিন্দা ছালেহা বলেন, নিয়মিত এখানে দেখি এতিমখানার নামে টাকা কালেকশন করে যাচ্ছে কিছু লেবাসধারির। আসলে তারা ভদ্রবেশে এক প্রকার নিরব চাঁদাবাজি করছে। অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে , লিফলেট বা রশিদের নাম থাকলেও অনুসন্ধানে অনেক প্রতিষ্ঠান খুঁজেই পাওয়া যায়না। নগরীর মার্কেট, হাট-বাজার, বাস র্টামিনাল ও লঞ্চঘাট সহ বিভিন্ন অলিগলিতে দিন রাত চলে এ’ধরণের নিরব চাঁদাবাজি। বরিশালে অন্তত দশটি স্পটে চলছে মাদ্রাসার নামে টাকা আদায়। কিন্তু মাদ্রাসায় গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষার্থী নিজ খরচে লেখাপড়া তো দূরের কথা, মাদ্রাসারই কোন সন্ধান নেই প্রদত্ত রশিদের ঠিকানায়। আবার নেই কোনো এতিম শিশুও। তবুও চলছে এতিমখানার নামে টাকা উত্তোলন। ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে এতিমখানার নামে সাধারন মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এই প্রতারক চক্রে সদস্যরা। এতিমখানার রিসিভ নিয়ে অনুসন্ধানে গিয়ে দেখা যায়, বরিশাল সদর উপজেলার লামচরি বশিরিয়া এতিমখানা মাদ্রাসা এবং রুপাতলী দারুল কুরআন আব্বাসিয়া মাদ্রাসার রশিদ বই ছাপিয়ে র্দীঘ দিন ধরে মানুষের কাছ থেকে টাকা কালেকশন করে বেড়াচ্ছে প্রতারক জাহাঙ্গীর ও রিফাত বাহিনী। এই জাহাঙ্গীর ও রিফাত এতিমখানার নাম বলে বিভিন্ন জায়গা অনুদান থেকে শুরু করে সব ধরনের সাহায্য এনে এটা নিজেরাই ভাগাভাগি করে নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয় ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞার সময়ে প্রশাসনের অভিযানে জব্দকৃত জাটকা যখন এতিমখানায় বিতরন করা হয়। তখন তারা এমিখানার নামে রশিদ দিয়ে ছাত্রদের খাওয়ানোর কথা বলে মাছ নিয়ে বাহিরের বাজারে বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও জাহাঙ্গীর, রিফাত ও রায়হান যাকাতসহ বিভিন্ন অনুদানও আনে মাদ্রাসার নামে। রিফাত পলাশপুর রহমানিয়া মাদ্রাসার এতিমখানার নাম বলে চাউল ডাল নিয়ে বাহিরে বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধেও। পরে মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জেনে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে চাইলে হাত-পা ধরে রক্ষা পায়। রিফাত ঝালকাঠি জেলার কাঠালিয়ার দক্ষিন শৌলজালিয়া গ্রামে বাসিন্দা ইউনুস শরীফের ছেলে। তিনি নগরীর কাউনিয়া ব্রাঞ্চ রোডের একটি মাদ্রাসায় কিছুদিন পড়ালেখা করেই নিজেকে হাফেজ পরিচয় দিয়ে এতিমখানার নামে অর্থ উত্তোলন করে হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে ভোলার মনপুরা মাস্টার হাট এলাকার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর নগরীর রূপাতলী দারুল কোরআন আব্বাসিয়া মাদ্রাসার নাম ব্যবহার করে বছরের পর বছর ধরে টাকা উত্তোলন করে যাচ্ছে। জাহাঙ্গীর নিজেকে কখনও মাদ্রাসার পরিচালক, আবার কখনও নিজের একজন বক্তা হিসেবে মানুষের কাছে উপস্থাপন করেন। এছাড়াও মাদ্রাসা ও এতিমখানার নামে মানুষের কাছ থেকে কোরআন শরীফ এনে সেগুলো গীর্জ্জা মহল্লার একটি দোকানে বিক্রি করেন। জাহাঙ্গীর এতিমদের নামে টাকা উত্তোলন করে কালিজিরা এলাকায় একটি মাছের ঘের করেছেন। হয়েছে কয়েক লক্ষ টাকার মালিক। অভিযুক্ত জাহাঙ্গীরের কাছে কোন এতিমখানায় কাজ করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, নগরীর রহমানিয়া এতিমখানার নামে একটি মাদ্রাসার টাকা কালেকশন করি। তিনি আরও বলেন, আগে আমার মাদ্রাসা ছিলো। এখন নেই। তাই অন্যের মাদ্রাসায় কাজ করি পেট চালানোর জন্য। তবে জাহাঙ্গীর যে মাদ্রাসার পরিচয় দিয়েছে সে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, আমাদের মাদ্রাসায় বর্তমানে জাহাঙ্গীর নামে কেউ টাকা উত্তোলন করে না। যদি কেউ মাদ্রাসার পরিচয় দিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা কালেকশন করে থাকে তার বিরুদ্ধে প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হোক। রিফাত নামে আরেক প্রতারক চক্রের সদস্যর কাছে কোন এতিমখানার নামে টাকা উঠাচ্ছেন। তিনি বলেন, আমি জাহাঙ্গীর হুজুরের সাথে র্দীঘ দিন ধরে কাজ করছি তার সহযোগী হিসেবে। এছাড়াও নগরীর ত্রিশ গোডাউন সংলগ্ন আর্মড ব্যাটালিয়নের পাশে একটি বাসার দোতলার দুইটি রুম ভাড়া নিয়ে আবু রায়হান করেছে জাহানারা বেগম নূরানী হাফিজি মাদ্রাসা। যেখানে নিজেই শিক্ষক, নিজেই পরিচালক ও খাদেম। পাশাপাশি রায়হান সহ তার প্রতারক চক্রের সদস্যরা এতিমখানা ও মাদ্রাসার নামে করছে নিরব চাঁদাবাজি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে শুধু বরিশাল শহরই নয় গোটা দক্ষিণাঞ্চলে বেশ কিছুদিন ধরে ভুয়া রশিদ নিয়ে হাট-বাজার ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে মাদ্রাসা ও এতিমখানার নামে চাঁদা তুলছে প্রতারক চক্রের সদস্যরা। মানুষের সরল অনুভূতি ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে পুঁজি করে এরা জমজমাট ব্যবসায় পরিনিত করেছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের বরিশাল জেলা কার্যালয়ের উপপরিচাক এ,কে,এম আখতারুজ্জামান তালুকদার বলেন, এটা দেখার বিষয় আমাদের নয়। আমাদের এখান থেকে রেজিস্ট্রেশনকৃত মাদ্রাসা ও লিল্লাহ বোর্ডিং বাদে যারা এ ধরনের প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন তাদের দেখভালের দায়িত্ব মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসনের। বরিশাল জেলা শিক্ষা অফিসার মো. হারুনুর রশীদ বলেন, মাদ্রাসার ছোট ছোট শিশুদের দিয়ে এ ধরনের চাঁদা কালেকশন কোনভাবেই কাম্য নয়। মাত্র তিন মাস আগে তিনি বরিশালে যোগদান করেছেন এ কারণে এই ধরনের কোন অভিযোগ এখন পর্যন্ত তার দৃষ্টিতে আসেনি। তবে উপযুক্ত প্রমাণ সাপেক্ষে এ ধরনের অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনের ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি। পাশাপাশি এতিমখানা বা লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের নামে যদি কোন প্রতিষ্ঠান চাঁদাবাজি করে তাদেরকে পুলিশের সোপর্দ করার পরামর্শ দেন তিনি। এ বিষয়টি নিয়ে বরিশাল মেট্টোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ ইমদাদ হুসাইন এর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি আপনার কাছ থেকে শুনলাম। তবে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য যদি থাকে তাহলে দেন। আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবো। একই বিষয় নিয়ে বরিশাল জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন এর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আমি যোগদানের পর থেকে জেলা প্রশাসনের কার্যলয়ে থেকে যে সকল মাদ্রাসা, মসজিদ ও এতিমখানা পরিচালনা করার জন্য যে প্রতিষ্ঠানকে অনুদান দেওয়া হচ্ছে তা তদন্ত করে দেওয়া হচ্ছে। আমি যোগদানের পর থেকে মসজিদ,মাদ্রাসা ও এতিমখানায় অনুদানের জন্য আবেদন করা প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের খোঁজ খবর নিয়ে যদি দেখি তারা সঠিক রয়েছে, তাহলে তাদেরকেই অনুদান প্রদান করা হয়। তিনি আরও বলেন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমি নিজে মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলোর বিষয়ে তদন্তে নেমে দেখতে পারলাম যে ২০% মাদ্রাসা ও এতিমখানা গুলো ভূয়া। শুধু তাই নয় অনুদানের জন্য আবেদন করা কয়েকটি এতিমখানার যে ঠিকানা গুলো দেওয়া হয়েছে তার কোন অস্তিত্ব নেই উল্লেখিত সেই ঠিকানায় জানিয়ে তিনি বলেন, এ ধরণের চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে খুব শিঘ্রই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে আমাদের সবাইকে এই বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।