বরিশাল বিভাগে বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া, দায়িত্বে ৫ কেন্দ্রীয় নেতা!
দেশ জনপদ ডেস্ক|১৯:১৮, জানুয়ারি ৩১ ২০২৫ মিনিট
দেড় দশক পর বরিশাল বিভাগে বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের প্রায় ছয় মাস পর এই উদ্যোগ নিয়েছে দলটি। এ জন্য ছাত্রদলের সাবেক পাঁচ কেন্দ্রীয় নেতা, যাঁরা বর্তমানে বিএনপির কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে সক্রিয়, তাঁদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁদের বিভাগের আটটি সাংগঠনিক জেলায় সম্মেলন করার জন্য প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক মনোনীত করা হয়েছে।
সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির দায়িত্ব পাওয়া নেতারা জানান, এই কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য হলো দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা ও তরুণ নেতৃত্বের মাধ্যমে দলকে পুনরুজ্জীবিত করা। এবার ওয়ার্ড থেকে জেলা পর্যন্ত প্রতিটি কমিটি গঠিত হবে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে। এই পদ্ধতি দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চার এক নতুন অধ্যায় সূচনা করবে। পাশাপাশি এটি তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদেরও আরও সক্রিয় অংশগ্রহণে উৎসাহিত করবে। তবে বরিশাল অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ নেতারা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত না থাকলে পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া কঠিন হবে বলে শঙ্কা রয়েছে।
বিএনপি গত দেড় দশকে বিভিন্ন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও সাংগঠনিক দুর্বলতার সম্মুখীন হয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়নে দলটির নেতা-কর্মীরা রাজপথে দাঁড়াতে পারেননি। মামলা-গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাড়িঘরে থাকতে পারেননি। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই তৃণমূল পর্যায়ে নেতৃত্বের অভাব, অভ্যন্তরীণ বিভেদ ও কেন্দ্রীয় নির্দেশনার অভাবে দলের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছিল। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নতুন পরিস্থিতিতে দলটির নেতা-কর্মীরা আবার সক্রিয় হয়েছেন। তবে ভঙ্গুর সাংগঠনিক কাঠামোর কারণে তাঁরা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণহীন। এমন পরিস্থিতিতে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন।
২৩ জানুয়ারি দলের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে বরিশাল বিভাগের আট সাংগঠনিক জেলায় সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ও বরিশাল বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু ও বিভাগের সহসাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমানের স্বাক্ষরিত পৃথক দুটি চিঠিতে এই কমিটির ঘোষণা দেওয়া হয়।
এতে বরিশাল মহানগরের আহ্বায়কের দায়িত্ব পেয়েছেন কেন্দ্রীয় সদস্য হাসান মামুন। বরিশাল দক্ষিণ ও ঝালকাঠি জেলার দায়িত্বে ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি, বর্তমানে বিএনপির কেন্দ্রীয় সদস্য হায়দার আলী লেলিন ও বরিশাল উত্তর জেলার দায়িত্বে কেন্দ্রীয় নেতা দুলাল হাওলাদার। ভোলার আহ্বায়ক করা হয়েছে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাসের মোহাম্মদ রহমতুল্লাকে। পিরোজপুর ও বরগুনা জেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় সদস্য ও সাবেক ছাত্রদল নেতা কাজী রওনাকুল ইসলামকে (টিপু)। পটুয়াখালীতে বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির নেতৃত্বেই সম্মেলন হবে।
কাজী রওনাকুল ইসলাম বলেন, ‘দলের ভালোর জন্য, নতুন নেতৃত্ব বিকাশের জন্য ও দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা কার্যকর করার জন্য আমাদের নেতা তারেক রহমান এই দায়িত্ব দিয়েছেন। এই দায়িত্ব আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করব। এতে চ্যালেঞ্জ আছে, তবে ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, আগে দল, তারপরে অন্যকিছু, এটা তারেক রহমানের নির্দেশ।’
কাজী রওনাকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘সময়ের প্রয়োজনে প্রবীণদের পাশাপাশি নবীনদের সমন্বয় করা প্রয়োজন। এ জন্য দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে নেতা নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়া তাঁদের কাছে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মানুষের কাছে, দলের নেতা-কর্মীদের কাছে যিনি গ্রহণযোগ্য, তিনিই নেতা হবেন, এটাই তো গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। আমাদের নেতা তারেক রহমান এ বিষয়ে আমাদের কঠোর মনোভাবের কথা জানিয়েছেন এবং আমরা তাঁর নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছি।’
সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির দায়িত্ব পাওয়া এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এ অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ নেতারা এমন প্রক্রিয়ায় নাখোশ। এ ক্ষেত্রে এটা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে। কিন্তু আমরা ব্যর্থ হব না। সময়ের প্রয়োজন মেনে নিয়েই এটা সবাইকে মানতে হবে। আর জ্যেষ্ঠ নেতারা যদি সেটা না মানেন, তাহলে সেটা উভয়ের জন্য দুর্ভাগ্যজনক হতে পারে।’
বরিশাল অঞ্চলের দুই জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাঁদের ভাষ্য, ভোটের মাধ্যমে কমিটি গঠনের নতুন এই পদ্ধতি তাঁদের আঞ্চলিক রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের প্রভাবকে হুমকিতে ফেলবে। দীর্ঘদিনের অনুসারীদের দিয়ে কমিটি গঠনের যে সংস্কৃতি ছিল, তা এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভেঙে যাবে। এ ছাড়া তরুণ নেতাদের অভিজ্ঞতার ঘাটতি আছে। এটি নিয়েও তাঁদের শঙ্কা রয়েছে।
তবে দলের এই পুনর্গঠনের প্রক্রিয়াকে ইতিবাচকভাবে দেখেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মজিবর রহমান সরোয়ার। তিনি বরিশাল-৫ (সদর) আসনের পাঁচবারের সংসদ সদস্য ছিলেন। একই সঙ্গে জাতীয় সংসদের হুইপ ও বরিশাল সিটির প্রথম মেয়র ছিলেন। তিনি বরিশাল মহানগর বিএনপিকে প্রায় ২০ বছর নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন নিয়ে সভায় আমিও ছিলাম। দলের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চার জন্য এবার ভোটের মাধ্যমে কমিটি করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এটা আমাদের গঠনতন্ত্রেও রয়েছে, সেটা বাস্তবায়ন হবে। এটা ভালো উদ্যোগ। তবে দীর্ঘদিনের প্র্যাকটিস ছিল সাবজেক্ট কমিটির মাধ্যমে নেতা নির্বাচন করা এবং যে এলাকায় যেসব জ্যেষ্ঠ নেতা থাকবেন, তাঁদের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে নতুন এই প্রক্রিয়াকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখি।’
বরিশাল বিভাগে সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহসাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান বলেন, ‘এই প্রক্রিয়ার ফলে দলে কর্মীদের মতামতের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা পাবে। এতে তাঁরা পছন্দমতো নেতা নির্বাচন করার সুযোগ পাবেন এবং নেতাদের জবাবদিহিতার বাধ্যবাধকতা তৈরি হবে। এতে চ্যালেঞ্জ আছে, বাধা আছে, এটা আমরা টের পাচ্ছি। তবে তারেক রহমানের এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’