বরিশালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বই না পাওয়ায় বিদ্যালয়ে যেতে অনাগ্রহ শিক্ষার্থীদের
নিজস্ব প্রতিবেদক : বরিশাল সদর উপজেলার চরকাউয়া এলাকার একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দু-একটির বেশি ক্লাস হয় না, তাই শিক্ষার্থীরা মাঠে খেলাধুলা ও ঘুরেফিরে সময় কাটায়। সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী মেহরাব হোসেন ও ষষ্ঠ শ্রেণির ইয়াসিন খান দুপুর ১২টায় গল্প করতে করতে বিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফিরছিল। তারা দুজনই বরিশাল সদর উপজেলার চরকাউয়া এলাকার তোফায়েল আহমেদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। এই সময়ে বাড়ি ফেরা কেন, প্রশ্ন করতেই বলল, ‘করমু কী, স্কুলে ক্লাস অয় না। কেন হয় না, এমন প্রশ্ন শুনে তারা বলে বই না থাকলে ক্লাস করমু ক্যামনে। প্রতিদিন দুই-তিনটা ক্লাস অয় তারপর।
গ্রাম ও শহরের বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ে গিয়ে ওই দুই শিক্ষার্থীর কথার সত্যতাও পাওয়া গেল। বিভিন্ন বিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষকও জানালেন পাঠদানের সমস্যার কথা। কবে নাগাদ এ সমস্যার সমাধান হবে জানেন না কেউই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বরিশালের মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্তরের অন্তত সাতজন শিক্ষক জানান, নতুন বছর শুরুর আগেই এক বছরের শিক্ষাপঞ্জি প্রকাশ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে বছরে কত দিন ক্লাস হবে, পরীক্ষা নেওয়া হবে কবে—এসবের উল্লেখ করে দেওয়া হয়। বিভিন্ন বিদ্যালয় শিক্ষাপঞ্জির বাইরেও শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাইয়ের জন্য আরও কিছু পরীক্ষা নেয়। সেটাও বছরের শুরুতে ঠিক করে দেয় বিদ্যালয়গুলো। কিন্তু ২০২৫ শিক্ষাবর্ষ শুরু হলেও এবার এখনো বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পাঠ্যবই হাতে না পাওয়ায় এই পরিকল্পনা হোঁচট খেয়েছে। বই না পাওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ কমেছে। ফলে স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও কম। শিক্ষকদের বই ডাউনলোড করে পড়াতে বলা হলেও শিক্ষার্থীদের হাতে কপি না থাকায় তাতে কারও আগ্রহ তৈরি হচ্ছে না। এতে বিদ্যালয়গুলোতে দু-একটি ক্লাস হচ্ছে। শিক্ষকেরা বাকি সময় অলস পার করছেন।
শিক্ষার্থী মেহরাব-ইয়াসিনের কথায় এই অনাগ্রহের প্রমাণ পাওয়া গেল। তারা জানায়, তারা বাংলা, গণিত, ইংরেজি তিনটি বই পেয়েছে। ক্লাস হয় না, বাড়িতেও পড়তে পারে না। এখন বিদ্যালয়ে যেতে মন চায় না। অভিভাবকদের চাপে গেলেও ক্লাস না হওয়ায় দুপুর না গড়াতেই বাড়ি ফিরছে তারা।
তোফায়েল আহমেদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল, শিক্ষার্থীরা সবাই মাঠে খেলছে। শিক্ষকেরা অফিস কক্ষে নতুন বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। প্রধান শিক্ষক মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘বই এখনো সব বিতরণ হয়নি। তবু আমরা সাধ্যমতো ক্লাস নিচ্ছি।’ কীভাবে নিচ্ছেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, পিডিএফ থেকে ডাউনলোড করে কয়েকটি বিষয়ের পাঠদান করানো হচ্ছে।
এই বিদ্যালয় থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে কীর্তনখোলা নদীর তীরে চরকাউয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল, একতলা জরাজীর্ণ এই বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষগুলো শিক্ষার্থীতে ঠাসা। ৪০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩৮২ জন উপস্থিত। তবে এখানেও বই না পাওয়ার কথা শোনা গেল। প্রধান শিক্ষক জেসমিন খানম জানান, প্রাক্ থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থী বই পেলেও চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা মাত্র তিনটি বই পেয়েছে। চতুর্থ শ্রেণিতে ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান আর পঞ্চমে বাংলা, ইংরেজি, গণিত। তাহলে কীভাবে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাচ্ছেন—জানতে চাইলে জেসমিন খানম বলেন, ‘আমরা কিছু শিক্ষার্থীকে পুরোনো বই সংগ্রহ করে দিয়েছি। তা দিয়ে ওরা পড়াশোনা চালিয়ে নিচ্ছে। আমরা শিক্ষক সহায়িকা দিয়ে ক্লাসে পাঠদান চালাচ্ছি। তাই বেশি অসুবিধা হচ্ছে না।’ কিন্তু পুরোনো বই কি এবার চলবে—এই প্রশ্নে জেসমিন খানম
পঞ্চম শ্রেণির ঈশান, সোয়াত বলল, ‘নতুন বই পাইনি, তাই পুরোনো বই দিয়ে পড়াশোনা চালাচ্ছি। স্যাররা আমাদের পুরোনো বই জোগাড় করে দিয়েছেন।
এ তো গেল গ্রামের বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা। শহরের বিদ্যালয়গুলোতেও শিক্ষার্থীরা নতুন বই না পেয়ে হতাশায় আছে। বরিশাল নগরের আমতলা মোড়ে এআরএস বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় ঘুরে শিক্ষার্থীদের বই না পেয়ে হতাশার কথা শোনা যায়। সৈয়দা রাফিয়া এই বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী। রাফিয়া বলে, ‘বাংলা, গণিতসহ তিনটা বই পেয়েছি। বাকিগুলো কিছু ফোন থেকে পড়ি, কিছু পুরোনো বই সংগ্রহ করে, আর বাজার থেকে কিছু বই কিনেছি। যেমন জীববিজ্ঞান, উচ্চতর গণিত ইত্যাদি। এভাবে পড়াশোনা চালাতে অনেক সমস্যা হচ্ছে। জানি না কবে বই পাব, কবে পড়াশোনা শুরু করতে পারব।
এই বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির আয়শা সিদ্দিকা কোনো বইই পায়নি। তাহলে কীভাবে পড়াশোনা চলছে—জানতে চাইলে বলে, ‘খুব সমস্যা হচ্ছে। স্যাররা তাঁদের কাছে থাকা বই দিয়ে, পিডিএফ দিয়ে পড়াচ্ছেন। বাসায়ও আপাতত পিডিএফ থেকে পড়ছি এবং স্যাররা ক্লাসে যা পড়াচ্ছেন, লিখে দিচ্ছেন, সেটা পড়ছি। তবে অনেক সমস্যা হচ্ছে।
এআরএস বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ফটোকপি করে, পিডিএফ ডাউনলোড করে নিয়ে এবং শিক্ষকেরা শিট তৈরি করে দিচ্ছেন। কিছু শিক্ষার্থী হয়তো বাইরে থেকে কিছু বই কিনেছে। বই না আসা পর্যন্ত তো পড়াশোনা বন্ধ রাখা যাবে না।
একই এলাকায় কিশোর মজলিস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে প্রায় ২৯০ জন শিক্ষার্থী তিনটি করে বই পেয়েছে। বাকিগুলো পুরোনো এবং পিডিএফ ডাউনলোড করে পড়ানো হচ্ছে। বিদ্যালয়টির শিক্ষক আসমা পারভীন বলেন, ‘পুরোনো বই সংগ্রহ করেছি। সেগুলো দিয়ে এবং কিছু প্রশ্ন খাতায় লিখে দিয়ে পাঠদান চালাচ্ছি। পিডিএফ থেকে দেখে দেখেও কিছু পড়াচ্ছি।
শিক্ষার্বষ শুরু হওয়ার পর ১৯ দিন পার হয়েছে কিন্তু শিক্ষার্থীদের হাতে কবে নাগাদ বই পৌঁছাবে, এখনো নির্দিষ্ট করে জানাতে পারছেন না কেউ। তাই এ নিয়ে উদ্বেগে আছেন শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা।
কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা হলে তাঁরা বলেন, বছরের শুরুতে নতুন বই হাতে পেয়ে শিক্ষার্থীরা উৎফুল্ল মনে পড়াশোনার প্রস্তুতি নেয়। সিলেবাস শেষ করার জন্য শিক্ষকদেরও একটি পরিকল্পনা থাকে। কিন্তু এবার তা বিলম্বিত হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক সেই গতি কিছুটা মন্থর।
বরিশাল বিভাগের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ৩৩ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। কিন্তু বই হাতে না পাওয়ায় শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। বরিশাল বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বিভাগের ছয় জেলায় ৬ হাজার ২৪৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ১৮ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। এসব শিক্ষার্থীদের জন্য বইয়ের চাহিদা ৪৮ লাখ ৬২ হাজার ৫৬১টি। বছরের শুরুতে বিতরণ করা হয়েছে ১৭ লাখ ৯০ হাজার ১৭টি অর্থাৎ মোট ।
কিছু বই পর্যায়ক্রমে এসেছে বলে জানান বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের উপপরিচালক নিলুফার ইয়াসমিন। তবে কী পরিমাণ বই পাওয়া গেছে, এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি সঠিক তথ্য জানাতে পারেননি। নিলুফা ইয়াসমিন বলেন, শিগগিরই সব শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই পৌঁছাবে।
অপর দিকে বিভাগীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয় সূত্র জানায়, বিভাগে মাধ্যমিক ও সমমানের বিদ্যালয় রয়েছে ৩ হাজার ২৪৬টি। এসব প্রতিষ্ঠানে বইয়ের চাহিদা ১ কোটি ৭৫ লাখ ৫৫ হাজার ৯১৪টি। এর বিপরীতে গত রোববার পর্যন্ত বই পাওয়া গেছে ২১ লাখ ৭ হাজার ২৭০টি। এতে দেখা যাচ্ছে বিভাগে মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ১২ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছেছে।
বিভাগীয় মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক জাহাঙ্গীর হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আশা করি জানুয়ারি মাসের মধ্যে সব শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছাবে।