বরিশালে পড়ছে ‘তীব্র শীত’ মন্দা যাচ্ছে ‘মানুষ কেনা-বেচা’
নিজস্ব প্রতিবেদক : বরিশালে পড়ছে ‘তীব্র শীত’। আর এই শীতের কুয়াশার মধ্যে বাঁশের টুকরি আর কোদাল হাতে মানুষগুলো ভিড় জমাচ্ছেন ‘মানুষ বেচা-কেনার হাটে’। প্রাচীনকালে ও মধ্যযুগে সমাজে মানুষ কেনাবেচার হাট বসত। সেই দাসপ্রথা এখন কিছুটা বিলুপ্তির পথে।
কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর তথ্যপ্রযুক্তির যুগেও ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের নির্মম আঘাতে নিন্ম আয়ের মানুষগুলো দুই বেলা রুটিরুজির জন্য আজও নিজেকে বেঁচে দেন মানুষ বেচা-কেনার হাটে। আয়ের সন্ধ্যানে প্রতিদিনই রাস্তার পাশে হাকডাক দিয়ে দাড়িয়ে থাকে একদল মানুষ।
‘মানুষ কেনা-বেচা’ হাটে শীতের কারণে খুব খারাপ অবস্থা যাচ্ছে, একদিন কাজ পেলে তিনদিন পাওয়া যায় না কাজ। তখন পরিবার-পরিজন নিয়ে না খেয়ে দিন কাটানো ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই। জড়িত কন্ঠে কথাগুলো বলছিলেন বরিশাল নগরীর মরগখোলা পোলে কাজের সন্ধ্যানে এসে দাড়িয়ে থাকা হালিম বেপারী (৪৫)।
শুধু হালিম বেপারীই নয়। সাগরদী ও মরগখোলা পোলসহ নগরীর বেশ কয়টি স্থানে শ্রমিক বেচা কেনার এই চিত্র দেখা যায় শীতে। একদিন কাজ পেলে তিন দিন অলস সময় পার করতে হয় তাদের। আর এই হাড় কাপানো শীতের কারণে শ্রমিকের বাজার মন্দা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন একাধিক শ্রমিকরা। তাই সরকারের কাছে তাদের দাবি স্থায়ী কোন কাজের পাশাপাশি সরকারি সহায়তা করা হোক।
সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কনকনে শীত আর কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া সকালে রাস্তায় মানুষের দেখা মেলেনা তেমন। ঠিক সেই সময় শীতে কাঁপতে কাঁপতে আয়ের সন্ধ্যানে নগরীর রুপাতলী সড়ক, মরগখোলার পোল, চকের পোল, কাশিপুর বাজার, কালিজিরা বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে রাস্তার পাশে একদল নারী পুরুষ বসে রয়েছে কাজ পাওয়ার অপেক্ষায়। তাদের কারও হাতে রয়েছে কাস্তে-কোদাল, ভেলচা, কারও হাতে বাঁশের ঝুঁড়ি, কারও হাতে দড়ি, পানি রাখার ড্রাম, কারও হাতে হাতুরী, চিরা শ্যাপল, আর কাঠ দিয়ে বানানো ভারি জিনিস টানার সরঞ্জাম।
তবে মূল যা নিয়ে তারা এখানে বসেছেন তা তাদের শরীর। কেউ লম্বা, কেউ বেটে। কেউ সুস্থ্য-সবল, কেউ রোগা-পাতলা। ওটাই মূলত বিক্রি হয় ‘মানুষ কেনা-বেচা’ হাটে।
সুফিয়া বেগম নামে এক নারী শ্রমিকের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, স্বামী মারা গেছে আজ ৭ বছর। সংসারে আয় করা মত কেউ নেই। তাই আমিই হলাম ছেলে-মেয়েদের এক মাত্র ভরসা। তাই একদিন কাম না করলে ছেলে-মেয়েরা না খেয়ে থাকে। বড় মেয়ে কলেজে পড়ে। আর ছোট ছেলে এলাকার সরকারী একটি স্কুলে আষ্টম শ্রেনীতে পড়ে। তাদের পড়াশুনার জন্য প্রতিমাসে তাদের পিছনে ৬ হাজার টাকার উপরে খরচ হয়। তাই এই শীতের মধ্যেও কাজের সন্ধ্যানে আসতে হয় প্রতিদিন।
তিনি আরও বলেন গরীবের কষ্ঠের শেষ নেই। বর্তমানে বাজারে সব জিনিসের দাম দ্বিগুন। কিন্তু আয় আগের মতই।
এদিকে সাগরদী ব্রীজের ঢালে বয়স্ক হেমায়েত বলেন, সংসারে আমার এক মেয়ে আর স্ত্রী ছাড়া কেউ নাই। তাই এই বয়সেও খেটে খেতে হচ্ছে। একদিন কাজ না হলে বাড়ির সবাই না খেয়ে থাকে। কি আর করবো শীত,বৃষ্টি আর গরম নেই কাজ না করলে ভাত দিবে কে। তার মধ্যে তবে শ্রমিকের চাহিদা একেবারে নেই বললেই চলে। তিনি আরো বলেন, সরকার পরিবর্তনের পর সিটি করর্পোরেশন বাড়ি-ঘর তৈরির অনুমতি দিচ্ছে না তার বাজারে আমাদের দিন খেটে খাওয়া শ্রমিকদের চাহিদা নাই বললেই চলে।
বরিশালে শ্রমিকের দৈনিক পারিশ্রমিক ৭০০ টাকা থেকে এখন ৫০০ টাকায় চলছে। তবুও কাজ পাছে না অধিকাংশ শ্রমিকরা। কাজ না পেলে অনাহারে অর্ধাহারে সময় কাটাতে হয় তাদের। তাই বাধ্য হয়েই কম টাকাতেও কাজে যাচ্ছেন অনেকে শ্রমিক।
দিন খেটে খাওয়া অধিকাংশ শ্রমিকদের রয়েছে আশা, ব্রাক, গ্রামীন শক্তি, পল্লীসহ একাধীক এনজিও কাছ নেওয়া লোন। কাজ হোক আর নাই হোক সপ্তাহিক কিস্তিতে নেই কোন মাপ। কিস্তি না দিতে পারলে শুনতে খারাপ আচারন। এবং অনেক বাড়ি ঘরে থাক মালামাল বিক্রি করেও দিতে হচ্ছে কিস্তির টাকা। এযেন দেখার কেউই নেই। প্রতিদিন ভোর থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত পয়েন্ট গুলোতে জমজমাট থাকে শ্রমিকের বেচাকেনা। প্রয়োজন অনুযায়ী চলমান বাজারদরে এসব এলাকা থেকে সহজেই দৈনিক মজুরিতে নগরের বিভিন্ন জায়গায় কাজে যান তারা। এ এক নিত্যদিনের চিত্র।
বরিশালের কয়েকজন ঠিকাদারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক প্লান অনুমোদনে জটিলতা ও হয়রানি চলছে। প্রায় দেড় বছর ধরে প্লান অনুমোদনে জটিলতা থাকায় হাজার হাজার নির্মাণ শ্রমিক, জমির মালিক, ব্যবসায়ী, ইঞ্জিনিয়ার ও আর্কিটেক্ট বৃন্দসহ নান পেশার মানুষ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তাই এই সমস্যা গুলো কারনে কর্মহীন হয়ে পড়ছেন ‘মানুষ কেনা-বেচা’ হাটের দিন খেটে খাওয়া মানুষ গুলো।
বরিশাল সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) এর সাবেক সভাপতি প্রফেসর শাহ সাজেদা বলেন, বেশ কিছু দিন ধরে বরিশালে প্রচুর ঠান্ডা পড়ছে। তার মধ্যেও দিন খেটে খাওয়া মানুষ গুলো আয়ের উদ্দ্যেসে কুয়াশার মধ্যে কাজের খোঁজে বের হচ্ছে। কারন তারা কাজ না করলে না খেয়ে থাকবে তার পরিবারের সদস্যরা। তবে সরকারের পক্ষ থেকে দিন খেটে খাওয়া এই মানুষ গুলোর দিকে নজর নেওয়া খুবই প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।