বরিশালসহ ২১ জেলায় ঘনঘন লোডশেডিং, জনজীবনে অস্থিরতা
সপ্তাহখানেক ধরে বরিশালে ঘনঘন লোডশেডিং চলছে। দিন-রাত মিলিয়ে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধ থাকায় বিদ্যুৎনির্ভর ব্যবসাবাণিজ্য যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনই গরমে জনজীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। এর কারণ হিসেবে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, ‘বিদ্যুৎ জেনারেশন ঘাটতি’ যার অর্থ হলো, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং আমদানি করা বিদ্যুৎ খরচ মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। এমন পরিস্থিতিতে, বিদ্যুৎ বিতরণ ক্ষণিকের জন্য বন্ধ করে ব্যবহার সীমিত করতে হয়। বিদ্যুতের এই জেনারেশন ঘাটতির কারণেই বরিশালসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় লোডশেডিং চলছে। গত বছরও অনুরুপ জেনারেশন ঘাটতি দেখা দিয়েছিল, সে সময়ও ৬ থেকে ৭ ঘণ্টার বিদ্যুৎবিভ্রাট দেখা দিয়েছিল, ফলে তখন দেশের গ্রাহকরা দিনের বিভিন্ন সময়ে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিভ্রাটের শিকার হয়েছিলেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, বছরের পর বছর এই অস্বাভাবিক বিদ্যুৎবিভ্রাট থেকে উত্তরণে একমাত্র পথ হচ্ছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। যা সরকারের তরফ থেকে করা হচ্ছে, ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালা বদলের কারণে কিছুটা বিলম্বিত হচ্ছে। তবে বিদ্যুৎ জেনারেশন ঘাটতি নিয়ে বিস্তর কথা বলতে চাননি বরিশাল ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো-১) নির্বাহী প্রকৌশলী মলজুল কুমার স্বর্ণকার।
বিদ্যুৎবিভ্রাট এবং প্রচণ্ড গরম আবব জনজীবন ত্রাহি অবস্থা করে তুললেও ওজোপাডিকো কর্মকর্তাদের ‘জেনারেশন ঘাটতি’ অজুহাত দেখানো শেষ হবে তা তারাও বলতে পারছেন না। বরিশাল বিভাগীয় শহরে এই ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং কারেন্টনির্ভর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মালিক-কর্মচারী-শ্রমিকদের জীবন দুর্বিসহ করে তুলেছে। এক্ষেত্রে বেশি মাত্রায় আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বরিশাল বিসিক শিল্পনগরীর কারখানা মালিকেরা।
বিসিকের একাধিক কারখানা মালিক অভিযোগ করেন, রাতে বিদ্যুৎবিভ্রাট কম থাকলেও দিনের বেলা বেশি দেখা যায়, যখন শ্রমিকেরা ডিউটি করেন। ফলে কাজ বন্ধ থাকায় শ্রমিকদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বিদ্যুতের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। কখনও কখনও বিদ্যুৎ একবার গেলে, আসতে ২/৩ ঘণ্টাও লেগে যায়। পণ্য উৎপাদন বন্ধ থাকলে এতে মালিকেরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, হচ্ছেন, এটা স্বাভাবিক।
বিসিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান মালিকদের সভাপতি সুন্দর আলমের সাথে যোগাযোগ করা না গেলেও অধিকাংশ সদস্য বলছেন, বিদ্যুৎবিভ্রাটের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংগঠনের সভাপতি-সম্পাদকসহ নেতৃবৃন্দ ২/১ দিনের মধ্যে ডিজিএম নজরুল ইসলামকে জানাবেন। অবশ্য বিসিক কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বিদ্যুৎবিভ্রাটের বিষয়টি স্বীকার করলেও বলছেন শিল্পমালিকেরা আবেদন দিলে বিদ্যুৎ বিভাগ এবং তার উর্ধ্বতনদের অবহিত করতে পারেন।
শুধু এই শিল্প এলাকায় নয়, গোটা বরিশাল মহানগরীতেই দিন-রাত সমান্তরাল বিদ্যুৎবিভ্রাট দেখা দেয়। শহরের ৯ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ও হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী মো. রাকিবুল হাসান জানান, তার এলাকায় প্রতিদিন লোডশেডিং হয়, হচ্ছে। বিশেষ করে গত বুধ-বৃস্পতিবার ছিল মাত্রারিক্ত। ফলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা কিছুটা ব্যহত হয়। পত্রিশোর্ধ্ব যুবক রাকিব বরিশাল ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো-২) আওতাধীন।
তার অভিযোগ, মাস শেষে বিদ্যুৎ বিল দেই ঠিকই, কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী বিদ্যুৎ কখনও কখনও পাইনি। আবার কোনো কোনো মাসে অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ বিলও আসে, যা নিয়ে অভাবে টানাটানি শুরু হয়। অনুরুপ ভোগান্তির কথা জানিয়েছেন, স্বরোড, দপ্তরখানাসহ বাজার রোড এলাকার একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মালিক এবং বাসিন্দারা, পাশাপাশি ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন।
অবশ্য ওজোপাডিকো-২ জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী মঞ্জুরুল ইসলামও ঘনঘন লোডশেডিংয়ের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। এবং তার সমমযার্দার কর্মকর্তা ওজোপাডিকো-১ জোনের প্রকৌশলীর বিদ্যুৎ জেনারেশন ঘাটতির অজুহাতকেই সমর্থন করেছেন। বলছেন, চাহিদা অনুপাতে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না, বিশেষ করে বুধ-বৃহস্পতিবার বেশি সময় ধরে এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। এর কারণ হিসেবে কর্মকর্তা ব্যাখ্যা করেছেন, ফুয়েল সংকট রয়েছে, তাই চাহিদা মতে উদপাদন হয় না, বুধ-বৃহস্পতিবার চাহিদার অর্ধেক বিদ্যুৎ পাওয়া গেছে, তা সমবণ্টন করে দেওয়া হয়েছে। ফলে বিদ্যুৎবিভ্রাট বেড়ে যায়। তাছাড়া কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধও আছে, সেগুলো সচল হলে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আসবে, কমবে লোডশেডিং।
একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বরিশাল বিভাগের ৬ জেলা, খুলনা বিভাগের ১০ জেলা, ও বৃহত্তর ফরিদপুরের ৫ জেলাসহ মোট ২১ জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো)। এই ২১ জেলায় বিদ্যুতের গ্রাহক রয়েছে প্রায় ১৪ লাখ ২৮ হাজার। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলা সদরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা (ওজোপাডিকো)। এই সংস্থার আওতায় বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলায় বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা ৪ লাখ ৭০ হাজার। এছাড়া বরিশালের পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর বিলিং গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ জন। আর বরিশাল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১-এর গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ২৬ হাজার ১৮৭ জন।
বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, ২১ জেলায় ওজোপাডিকোর আওতাধীন এলাকায় বৃহস্পতিবার বেলা ১টায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৬৫৯ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে সরবরাহ ছিল ৫৬০ মেগাওয়াট, অর্থাৎ লোডশেডিং ছিল ৯৯ মেগাওয়াট। এর মধ্যে শুধুমাত্র খুলনাতেই লোডশেডিং ছিল ৪৫ মেগাওয়াট। এছাড়া বরিশালে ১১ মেগাওয়াট, গোপালগঞ্জে ৫, নড়াইলে ২, মাগুরায় ৩, সাতক্ষীরায় ২, কুষ্টিয়ায় ৬, চুয়াডাঙ্গায় ৫, ফরিদপুরে ৬, রাজবাড়িতে ৪, মাদারীপুরে ৪, শরীয়তপুরে ২ ও ঝালকাঠিতে ৪ মেগাওয়াট লোডশেডিং ছিল।
এই বিদ্যুৎবিভ্রাট জনজীবনকে ওষ্ঠাগত করে তুললেন ওজোপাডিকোর স্থানীয় কর্মকর্তাদের কাছে কোনো সমাধানে কোনো সুযোগ নেই। কারণ বিদ্যুৎ সংরক্ষণ করা যায় না, যতটুকু উ;পাদন হয়, ততটুটুই সরবরাহ করা হয়। কিছুদিন ধরে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ না মেলায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়।
এই বিদ্যুৎসংকট থেকে উত্তরণে করণীয় কী জানতে চাইলে বরিশাল ওজোপাডিকো উভয় নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, লোডশেডিং কমিয়ে আনতে হলে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ অপচয়ও বন্ধ করা জরুরি। তবে এই সমস্যা আরও কদিন থাকতে পারেন, যেমন কিছুদিন পরে বিদ্যুৎ কেন্দ্র মেরামত করা হবে, তখনও কিছুটা বিদ্যুৎবিভ্রাট দেখা দিতে পারে। এরপরে সব কেন্দ্রগুলো সচল হলে জেনারেশন ঘাটতি কিছুটা মিটবে।’