বরিশালে দেদার বিক্রি হচ্ছে রোগাক্রান্ত মুরগি, সংক্রমণ মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা
নিজস্ব প্রতিবেদক : বরিশাল নগরীর দোকানগুলোতে দেদারছে বিক্রি হচ্ছে রোগাক্রান্ত ফার্মের মুরগি। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা এসব মুরগি পার্শ্ববর্তী জেলা-উপজেলাসমূহ থেকে কম মুল্যে সংগ্রহ করে বরিশালের বাজারগুলো রীতিমত বেচাবিক্রি করলেও স্থানীয় প্রশাসন তা বন্ধে কোনো উদ্যোগ বা পদক্ষেপ রাখছে না। বরং প্রশাসনের তদারকির অভাবে প্রতিনিয়ত রোগাক্রান্ত মুরগি বিক্রি করেই চলছে দোকানিরা। বাড়তি আয়ের ধান্ধায় ভাইরাস আক্রান্ত মুরগি মজুত করে মধ্যসত্বভোগীরা যেমন খামারিদের শঙ্কায় ফেলে দিয়েছেন, তেমনই ক্রেতা সাধারণের মধ্যে চরম ঝুঁকি তৈরি করেছেন।
অভিজ্ঞমহল বলছে, বাহির থেকে সংগ্রহ করা রোগাক্রান্ত মুরগিগুলো বাজার মূল্যের চেয়ে কমে ক্রয় করে নিয়ে আসা হয়। এবং খুচরা বাজারে তা ২০/৩০ টাকা কম মূল্যে বিক্রি করায় সাধারণ মানুষ কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। কখনও কখনও শহর তথা জেলার বিভিন্ন উপজেলায়ও মাইকিং করেও বিক্রি করতে দেখা যায়। রোগাক্রান্ত এই মুরগি থেকে স্থানীয় খামারে সংক্রামণ ছড়ানোর আশঙ্কা থাকছে, পাশাপাশি মানবদেহেও এ রোগ বাসা বাধার ঝুঁকি আছে। প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তর অনুরুপ আশঙ্কার কথা জানালেও প্রতিরোধে তাদের কোনো উদ্যোগ লক্ষ্যণীয় নয়।
দপ্তরটির কর্মকর্তা নুরে আলম জানান, মঙ্গলবার রাতে একটি অসুস্থ লেয়ার মুরগি তাদের কাছে পরীক্ষার জন্য নেওয়া হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে, এক কেজি ছয়শ গ্রাম ওজনের মুরগিটি এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত, যা এভিয়ান ফ্লু বা বার্ড ফ্লু নামেও পরিচিত। এই চিকিৎসক আরও জানান, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট একটি রোগ, যা প্রাথমিকভাবে পাখিদের প্রভাবিত করে। কিন্তু কখনও কখনও মানুষসহ স্তন্যপায়ী প্রাণীকেও প্রভাবিত করতে পারে। ফলে রোগাক্রান্ত মুরগি খেলে মানবদেহেও সংক্রামণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকছে।
এতসব ঝুঁকি জেনেও বরিশালের গুটিকয়েক ব্যক্তি ভাইরাস আক্রান্ত মুরগি জেলা-উপজেলা থেকে অর্ধেক মূল্যে সংগ্রহ করেছেন। এবং তা বরিশাল শহরের রুপাতলী, নথুল্লাবাদ, পোর্টরোডসহ বাজারগুলোতে পাইকারী ও খুচরা দরে বিক্রি করছে।
মিন্টন কবিরাজ নামের জনৈক ব্যক্তি জানান, তিনি মঙ্গলবার রাতে রুপাতলী এলাকার জসিমের দোকান থেকে এক কেজি ৬০০ গ্রামের একটি লেয়ার মুরগি ২৭০ টাকা দরে ক্রয় করেন। কিন্তু মুরগিটি বাড়ি নিয়ে যাওয়ার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়লে তা পরীক্ষার জন্য প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তরে নেওয়া হয়। সেখানের শীর্ষ কর্মকর্তা ডা. নুরে আলম পরীক্ষা শেষে বুধবার জানিয়েছেন, মুরগিটি এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত।
রুপাতলী হাউজিং বাজারের দোকানি জসিমসহ সেখানকার অপরাপর ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে রোগাক্রান্ত মুরগি বিক্রি করছেন, এমন অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছিল। মিল্টন জানান, সেই অভিযোগের সত্যতা খুঁজতে গিয়ে জসিমের দোকান থেকে বাজার দরের চেয়ে কেজিতে ৪০ টাকা কম মুল্যে মুরগিটি ক্রয় করেন। পরবর্তীতে প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তরে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করলে অভিযোগটি প্রমাণিত হয়। এই প্রতারণার ঘটনায় মিল্টন বরিশাল জেলা প্রশাসন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরসমূহে অভিযোগ দেওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন।
তবে দোকানি জসিম বলছেন, তিনি নিয়মিত মাসুদের কাছ থেকে মুরগি পাইকারী দরে সংগ্রহ করেন এবং পরবর্তীতে তা ভোক্তপর্যায়ে বিক্রি করেন। এতে তার কোনো দায় নেই বলে দাবি করেন। বাজার দর অপেক্ষ কম মূল্যে মুরগি কি ভাবে বিক্রি করে দায় এড়াতে চাইছেন- এমন প্রশ্নে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন দোকানি জসিম। পরিশেষে তিনি স্থানীয়দের চাপের মুখে স্বীকার করেন ‘মারিয়া পোল্ট্রি’ মালিক মাসুদের কাছ থেকে মুরগি সংগ্রহ করেন, ফলে এই বিষয়ে বিস্তারিত তিনিই ভালো বলতে পারবেন।
জানা গেছে, বরিশাল শহরের সিঅ্যান্ডবি ১ নং পুল এলাকার বাসিন্দা আলোচ্চ্য মাসুদ পিরোজপুরসহ আশপাশ জেলা থেকে রোগাক্রান্ত মুরগিগুলো কম দামে সংগ্রহ করে থাকেন। এবং তা পাশর্^বর্তী ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার আমিরাবাদপল্লীর নিজস্ব খামারে রেখে পরবর্তীতে বরিশাল শহরের বিভিন্ন বাজারের দোকানিদের সরবরাহ করেন বাজার দরের কিছুটা কম মূল্যে। সূত্র জানায়, শুধু মাসুদই নন, রুপাতলী এলাকার শাকিল ওরফে সাদ্দামসহ আরও অন্তত ১০/১৫ মধ্যসত্বভোগী রোগাক্রান্ত মুরগি বেচাবিক্রিতে জড়িত।
ভাইরাস আক্রান্ত মুরগি আগে সরকারি নির্দেশনার আলোকে মেরে মাটিচাপা বা পুড়িয়ে ফেলার উদাহরণ থাকলেও তা এখন অতীত। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে, এমন মুরগি কে কত কিনতে পারেন তার প্রতিযোগিতা দেখা যায়, যা আসলেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বলে মনে করছে সচেতন সমাজ। এমন কর্মকান্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাগ্রহণসহ জেলা প্রশাসন ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে নিয়োজিতদের তদারকি অর্থাৎ বাজার মনিটরিং জরুরি, মন্তব্য পাওয়া যায়।
সচেতন মহল জানিয়েছে, অসুস্থ মুরগি আমদানি বন্ধ না করা গেলে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা পর্যায়ক্রমে বরিশালে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াসহ রোগটি মানবদেহে বাসা বাধারও সম্ভবনা থাকছে। সুতরাং কালবিলম্ব না করে এখনই স্থানীয় প্রশাসনের এই বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার উচিৎ। পাশাপাশি ভোক্তার অধিকার হরণের সাথে সম্পৃক্ত মধ্যসত্বভোগীসহ দোকানিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসাও দরকার।
সূত্রগুলো জানায়, অতিরিক্ত অর্থ লাভের আশায় রোগাক্রান্ত মুরগিগুলো বেশিসংখ্যক নিয়ে আসছেন আলোচিত মাসুদ এবং শাকিল, তাদের নেটওয়ার্ক পটুয়াখালীর বাউফল-কুয়াকাটা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই দুজনকে দ্রুত রোহিত করা না গেলে এই অঞ্চলের পোল্ট্রিখাত প্রবল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকছে।
বরিশাল শহরের কজন ব্যবসায়ী জানান, মাসুদ এবং শাকিল মুরগি ব্যবসার নামে যে প্রতারণা শুরু করেছে, তা বন্ধ না হলে বিপর্যের আশঙ্কা থাকছে। তাদের আমদানি করা মুরগি থেকে ভাইরাস বরিশালের খামারে ছড়িয়ে পড়তে পারে, এমনটি যাতে না হয়।
প্রতারণার শিকার মিণ্টনের ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়ে জানতে চাইলে বিস্ময়প্রকাশ করেছেন খোদ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিপ্তর, বরিশালের শীর্ষ কর্মকর্তা অপুর্ব অধিকারী। তিনি বলেন, ফার্মের রোগাক্রান্ত মুরগি নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ী-দোকানিদের বাণিজ্য বন্ধে তার প্রতিষ্ঠান যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।’