যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে গৌরনদীর দধির সুখ্যাতি

আল-আমিন | ২১:০৫, জুন ১১ ২০২৪ মিনিট

যতদূর জানা যায়, গৌরনদীর দধির ইতিহাস অনেক পুরোনো। প্রায় আড়াই শ বছর আগে ডাওরি ঘোষ নামে এক ব্যক্তি গৌরনদীতে দধি তৈরি করে বেশ সফলতা পান। বংশ পরম্পরায় সেই ধারা ধরে রেখেছেন শচীন ঘোষ, ননী ঘোষ, গেদু ঘোষ, সুশীল ঘোষ, দিলীপ দাসসহ আরও অনেকেই। কারখানা মালিক গৌরাঙ্গ ঘোষ বলেন, গৌরনদীর দধির ইতিহাস দুইশ বছরেরও বেশি। আমি যে দোকানটি চালাচ্ছি সেটির বয়সই ৭৫ বছর হবে। তার আগে আমার বাবা, দাদা একই ব্যবসা করেছেন। গৌরনদীর দধি জনপ্রিয় হওয়ার একমাত্র কারণ হচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়া আলাদা। বিভিন্ন অঞ্চলে যে দধি তৈরি করা হয় তা ৭/৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রস্তুত শেষ হয়ে যায়। আমাদের গৌরনদীর দধি কমপক্ষে ৭২ ঘণ্টা সময় লাগে উৎপাদন প্রক্রিয়ায়। সেখান থেকে খাবারের জন্য পরিবেশনের জন্য প্রস্তুত করতে আরও ২৪ ঘণ্টা নির্ধারিত তাপমাত্রায় রাখা হয়। তিনি বলেন, গ্রামের গৃহস্থের গোয়ালের গরু থেকে আমাদের সরবরাহকারীরা দুধ দোহন করে নিয়ে আসেন। তার ঘনত্ব পরীক্ষা শেষে বড় কড়াইতে ১০০ ডিগ্রিরও বেশি তাপমাত্রায় ফুটাতে হয়। সকাল ৮টা থেকে শুরু করে রাত ৮টা-৯টা পর্যন্ত জ্বাল দিয়ে তারপর ঘন দুধ নামিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তা ঠান্ডা করে তাতে পরিমাণ মতো চিনি দিয়ে আবারো উনুনে উঠিয়ে জ্বাল দেওয়া হয়। এরপর তা নামিয়ে হাড়িতে ঢেলে প্রাকৃতিকভাবে ঠান্ডা করার জন্য রাখা হয়। ঠান্ডা করার পর সেই হাড়িভর্তি দধি চুলার অল্প আঁচে রাখা হয় ৬-৭ ঘণ্টা। সেখান থেকে নামিয়ে আবারও ২৪ ঘণ্টার জন্য ঠাণ্ডা করতে রাখা হয়। আরেক কারখানা মালিক শ্যামল চন্দ্র ঘোষ বলেন, দধিতে স্বাদ আনতে এত দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আমাদের কারখানার বয়সও ৭০-৭৫ বছর হবে। বাবাকে দেখেছি স্বাদ ও সুখ্যাতি ধরে রাখতে খাঁটি দুধ কিনতে কখনো কার্পণ্য করেননি। তিনি এখনো এই ব্যবসার প্রধান। তার নির্দেশনা অনুসারেই আমরা ব্যবসায় সফলতা পেয়েছি। সারাদিন দধি কিনতে দোকানে লোকজন ভিড় করে থাকে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অর্ডার আসে। পুরাতন ব্যবসায়ী ননী ঘোষ বলেন, গৌরনদীর দধির স্বাদ আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। তারপরও যা আছে তা দেশের অন্য কোনো দধির নেই। স্বাদ কমার কারণ হচ্ছে আগে দেশি গরুর দুধ পাওয়া যেত। এখন সব খামারের গরুর দুধ। দেশি গরুর প্রধান খাবার হচ্ছে ঘাস। কিন্তু খামারে কৃত্রিম খাবার খাওয়ানো হয়। গৌরনদী উপজেলায় বেশ কয়েকটি স্থানে দধি উৎপাদন হয়। এর মধ্যে ননী ঘোষের গৌরনদী ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডার আর সচীন ঘোষের গৌরনিতাই মিষ্টান্ন ভান্ডার সবচেয়ে বড় আর নামকরা। এই কারখানায় দধির পাশাপাশি শুকনা মিষ্টি, রসগোল্লা, রস মালাই, ক্ষীরপুরি, রসমঞ্জুরী, চমচম, কালোজাম, সন্দেশ ও বালুশাহ্সহ ১৪ প্রকারের মিষ্টিজাত খাদ্যপণ্য তৈরি হয়। গ্রাম থেকে দুধ সংগ্রহকারী, কারখানার সহযোগী, কারিগর, বিপনন মিলিয়ে দুটি কারখানায় দুই শতাধিক জনবল কাজ করেন। খোকন হাওলাদার নামে এক কর্মী বলেন, আমি গ্রামে গ্রামে হেঁটে দুধ সংগ্রহ করে কারখানায় দেই। এই কাজ করে আমার সংসার চলে। কারখানা না থাকলে আমার বেকার থাকতে হতো। আরেক কর্মী রাজ্জাক হাওলাদার বলেন, দধির কারখানা চালু থাকায় বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাজের ব্যবস্থা হয়েছে। দধি উৎপাদন কারখানা কেন্দ্রিক কাজে অন্তত এলাকার মানুষ ভালো আছি। কাজের জন্য আমাদের দূর-দূরান্তে যেতে হয় না। অল্প হলেও কর্মসংস্থানের যে ব্যবস্থা হয়েছে তা সবার জন্য ভালো। মিন্টু হাওলাদার নামে এক কর্মী বলেন বলেন, গৌরনদীর উন্নতির পেছনে দধির ব্যবসার বড় অবদান। এই অঞ্চলকে মানুষ এখন দধির জন্য গুরুত্ব দেয়। স্থানীয় একটি কলেজের শিক্ষক রাশিদা খানম বলেন, গৌরনদীর দধি, মিষ্টি, স্বাদে অসাধারণ। যুগ যুগ ধরে খাচ্ছি। কিন্তু এর স্বাদের কমতি হয়নি। বাবা-দাদার হাত ধরে যখন মিষ্টি খেতে আসতাম তখন যে স্বাদ ছিল এখনো দধি মুখে দিলে সেই আদি স্বাদ সুন্দর অনুভূতি দেয়। গৌরনদীর দধি দেশ ও দেশের বাইরে তার স্বনামে বিখ্যাত। এই দধিটির জিআই স্বীকৃতির দাবি জানাচ্ছি। স্থানীয় বাসিন্দা জিএম জসীম হাসান বলেন, ১৫০ টাকা কেজি দরে দধি পাওয়াটা কিন্তু অনেক সাশ্রয়ী। এই দধি আমাদের উপজেলা, এই জনপদকে অনেক উঁচুতে নিয়ে যাচ্ছে। সরকারের কাছে আবেদন গৌরনদীর দধিকে জিআই পণ্য হিসেবে ঘোষণা করে যেন গৌরনদীর ঐতিহ্যবাহী এই ব্যবসাকে সম্মানিত করা হয়।