সাইবার অপরাধ: ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসে বেশি ভুগছে নারী
নিজস্ব প্রতিবেদক :রাজধানীর একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী গত বছর ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে তাঁর নাম-ছবিসহ ভুয়া অ্যাকাউন্ট দেখতে পান। এরপর নিজের ফেসবুক আইডিতে একটি পোস্ট দিয়ে সবাইকে রিপোর্ট করতে অনুরোধ জানান। এ বিষয়ে আর কিছু তিনি জানেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ছাত্রী বলেন, ‘নিজের ফেসবুক আইডিতে একটি পোস্ট দিয়ে সবাইকে রিপোর্ট করতে বলেছি। পদক্ষেপ বলতে এটুকুই। জানি না, ফেক আইডিগুলো থেকে কাকে কাকে কী মেসেজ দিয়েছে।
সাইবারজগতে এভাবে ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসমূলক অপরাধের শিকার সবচেয়ে বেশি হচ্ছেন নারীরা। এ ছাড়া মোবাইল ব্যাংকিং বা অনলাইনে আর্থিক প্রতারণা বেশি হয়। ফলে সবচেয়ে বেশি মামলাও হয় এসব প্রতারণার। পুলিশ সদর দপ্তর ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, ‘সাইবার প্রতারণায় যারাই জড়িত, তাদের ধরা হচ্ছে। আমাদের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বেশ তৎপর। এই প্রতারণাগুলো সারা বিশ্বেই দেখা যায়। তবে সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমাদের ব্যবস্থা রয়েছে।’
পুলিশ সদর দপ্তরের এলআইসি (আড়িপাতা) শাখার পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন (পিসিএসডব্লিউ) ইউনিট সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের শিকার হওয়ার অভিযোগ যাঁরা করেছেন, তাঁদের মধ্যে ৩৯ শতাংশ নারী। তাঁদের মধ্যে ২২ শতাংশ নারী পদক্ষেপ নিলেও ৭৮ শতাংশই কোনো আইনি পদক্ষেপ নেননি। বরং তাঁরা নিজেদের আইডি বন্ধ বা কনটেন্ট (বিষয়বস্তু) মুছে ফেলতেই বেশি আগ্রহী।
ডিএমপির তথ্যমতে, ২০২০ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সাইবার অপরাধে যেসব মামলা হয়েছে, তার ৩৯ দশমিক ৮১ শতাংশই মোবাইল ব্যাংকিং ও অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণার।
পিসিএসডব্লিউর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত সেবাপ্রত্যাশীদের মধ্যে ৩৫ হাজার ৫২৫ জন নারী সাইবার স্পেসে হয়রানির শিকার হয়ে সহায়তা নিয়েছেন।
২০২২ সালের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ হাজার ৩০৪টি অভিযোগের মধ্যে ভুয়া আইডির মাধ্যমে তথ্য ফাঁসের অভিযোগ পড়ে ৯ হাজার ৭১৪টি। এর পর থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত ১৩ হাজার ৩১২টি অভিযোগ পাওয়া যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ব্যক্তিগত ছবি, মোবাইল ফোন নম্বর, বাসার ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বা কোনো পরিচিতিমূলক তথ্য অর্থাৎ ডক্সিংয়ের মাধ্যমে তথ্য ফাঁস করার। এ ধরনের ৫ হাজার ২৪১টি অভিযোগ জমা পড়ে, যা মোট অভিযোগের ৩৯ শতাংশ। এ ছাড়া ২ হাজার ৫২০ জন আইডি হ্যাকড হওয়ার শিকার, যা মোট অভিযোগের ১৯ শতাংশ।
পিসিএসডব্লিউর তথ্যমতে, গত এক বছরে যত অভিযোগ পড়েছে, তাতে ভুক্তভোগীর ১৪ শতাংশই অপ্রাপ্তবয়স্ক। প্রতি মাসে যত অভিযোগ আসে, তার ২২ শতাংশের আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বাকি ৭৮ শতাংশ ভুক্তভোগীই কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেন না বা নিতে চান না। ৩৩ শতাংশ ভুক্তভোগীর অবস্থান ঢাকা বিভাগে। ১৫ শতাংশ ভুক্তভোগী চট্টগ্রাম বিভাগের।
পুলিশ সদর দপ্তরের আড়িপাতা (এলআইসি) শাখার পুলিশ সুপার খালেদা বেগম বলেন, ব্যক্তিগত তথ্য ও ছবি ফাঁস হলেও ফেসবুক পেজ, হটলাইন নম্বর ও ই-মেইলে অভিযোগকারী নারীরা ভয়ে ও সামাজিক মর্যাদাহানির আশঙ্কায় ঘটনা গোপন রাখতে চান। আবার হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কায়ও অনেকে কিছু জানাতে চান না।
ডিএমপির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের তথ্যমতে, সাইবার অপরাধে ২০২০ সালের জুলাই থেকে ৪২টি, ২০২১ সালে ২০৬টি, ২০২২ সালে ১৭৮টি, ২০২৩ সালে ১৭০টি, ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত ৩১টি মামলা হয়েছে। মোট ৬২৮টি মামলার মধ্যে ২৫০টি মামলা হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণা ও অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণার।
এটি মোট মামলার ৩৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। এ ছাড়া পর্নোগ্রাফি ধারণ ও অনলাইন হ্যারেসমেন্টে ১২৩টি, মানহানিকর বক্তব্য প্রচার বা মিথ্যা তথ্য প্রচারে ১১২টি, ফেসবুক হ্যাকিং বা অন্যান্য হ্যাকিংয়ের ৪০টি মামলা হয়েছে। অন্যান্য কারণে মামলা ১০৩টি।
বিকাশ কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ডেমরা এলাকার বিকাশ এজেন্ট আব্দুল মমিনকে ফোন করে বলেন, বেশি কমিশন পেতে হলে কিছু তথ্য নবায়ন করতে হবে। এভাবে মমিনের কাছ থেকে তাঁর বিকাশ এজেন্ট ও অ্যাকাউন্টের পিনকোড এবং ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) নেওয়া হয়। পরে তাঁর বিকাশ অ্যাকাউন্ট থেকে ৪২ হাজার ৭৭৭ টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারক।
আব্দুল মমিন বলেন, ‘বিকাশের এজেন্ট হওয়ার পরদিনই বিকাশ কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে একজন ফোন দেন। তথ্য নবায়নের কথা বলে পিনকোড ও ওটিপি নিয়ে ৪২ হাজার ৭৭৭ টাকা নিয়ে নেয়। এরপর থানায় মামলা করি।’
ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইমের (উত্তর বিভাগ) অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. ফজলুর রহমান বলেন, ডিজিটাল প্রতারণার এসব মাধ্যম ব্যক্তিগত হওয়ায় নজরদারির সুযোগ কম। ফলে এই মাধ্যমগুলোতে আর্থিক প্রতারণার ঘটনা ঘটছে।
ডিএমপির কয়েকটি থানায় কথা বলে জানা গেছে, সাইবার অপরাধে মামলার সংখ্যা খুবই কম। যেসব মামলা বা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়, তার বেশির ভাগই আর্থিক ও অনলাইনে প্রতারণার। চলতি বছরের তিন মাসে তেজগাঁও ও শাহবাগ থানায় ৩টি করে, ডেমরা থানায় ২টি মামলা হয়েছে, যার সবই আর্থিক প্রতারণার। তবে বংশাল ও নিউমার্কেট থানায় কোনো মামলা বা জিডি হয়নি।
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বলেন, সাইবারজগতে আর্থিক প্রতারণার মূল কারণ ভুয়া এনআইডি দিয়ে বিকাশ, নগদ ও রকেট অ্যাকাউন্ট খোলা। ফলে তাকে নির্ণয় করা কঠিন হয়ে যায়। তাই অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সতর্ক হতে হবে কেউ যেন ভুয়া এনআইডি দিয়ে তা খুলতে না পারে। মানুষকে সতর্ক হতে হবে, যেন ওটিপি কোথাও শেয়ার না করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. তৌহিদুল হক বলেন, মোবাইল ও অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে অনেকেই নানাভাবে প্রতারণা করছে। এসব প্রতারণা নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও কৌশল বাড়ানো প্রয়োজন। সাধারণ মানুষ সচেতন না হলে এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে সতর্ক না হলে এ ধরনের প্রতারণা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।