গোয়েন্দা প্রতিবেদন: আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির শঙ্কা

কামরুন নাহার | ০৩:২৪, এপ্রিল ২৫ ২০২০ মিনিট

অনলাইন ডেস্ক ।। করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বিশাল জনগোষ্ঠী কাজ হারিয়েছে। উপার্জন বন্ধ হওয়ায় তারা কষ্টে জীবনযাপন করছে। এদিকে লকডাউনের প্রভাবে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাবার ও ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের চিত্র বেরিয়ে আসছে। জনপ্রতিনিধিদের কারও ঘরে সরকারের দেয়া ত্রাণের চাল, কারও খাটের নিচে টিসিবির সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে। এসব নিয়ে বাড়ছে জনমনে ক্ষোভ। সব মিলিয়ে আসন্ন রমজানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জনরোষ সৃষ্টিসহ ছিনতাই, রাহাজানি এবং জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে পারে। করোনা পরিস্থিতির সুযোগে জঙ্গিরা জাতীয় ঈদগাহসহ ঢাকা মহানগরীর অন্যান্য ঈদগাহে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঘটতে পারে। সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে এ আশঙ্কার কথা তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনটি এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব দফতরে পাঠানো হয়েছে। রমজানকেন্দ্রিক নিরাপত্তা প্রস্তুতির বিষয়ে বুধবার বিকালে এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, অতীতের বিভিন্ন সমস্যা-সংকট আমরা সফলভাবে মোকাবেলা করেছি। এবারও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে দিন-রাত আমাদের পেট্রোল অ্যাকটিভ থাকবে। র‌্যাব সদস্যরা সাদা পোশাকে দায়িত্ব পালন করবেন। ইন্টেলিজেন্স উইং এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে। আমরা সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করব। কোনো দুষ্কৃতকারীকে সফল হতে দেব না। করোনা পরিস্থিতিকে মাথায় নিয়েই আমরা নিরাপত্তা পরিকল্পনা গ্রহণ করছি। আমরা দেশবাসীকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, রমজানে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে। পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি এসএম রুহুল আমিন বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতিতে দেশবাসী এবার একটু অস্থির সময় পার করছে। তবে শুরু থেকেই পুলিশ জনসাধারণের পাশে রয়েছে। রমজানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এরই মধ্যে আমাদের গোয়েন্দারা মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ করছে। যেসব জায়গায় অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটানোর আশঙ্কা রয়েছে, সেসব জায়গায় বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সার্বিক বিষয়েই পুলিশ সদর দফতর এবং মাঠপর্যায়ের সদস্যরা সজাগ আছে। যদি কোন গোষ্ঠী দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির চেষ্টা চালায় তাহলে পুলিশ কঠোর হাতে দমন করবে। পাশাপাশি আগাম প্রস্তুতি হিসেবেও পুলিশের কিছু পদক্ষেপ নেয়া রয়েছে। কৌশলগত কারণেই এ মুহূর্তে এসব পদক্ষেপের বিষয়ে কিছু বলা হচ্ছে না।’ গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশাল জনগোষ্ঠীর কাজ ও আয় হারানোর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত জনগণকে উদারহস্তে সহায়তা দিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এ পদক্ষেপকে বানচাল করে নিজেরা লাভবান হতে কিছু সুবিধাভোগী এখনই মাঠে নেমে পড়েছে। দুস্থ ও গরিবদের মাঝে ত্রাণ বিতরণকে কেন্দ্র করে ঢাকা মহানগরীসহ দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সার্বিক অবস্থার অবনতি ঘটতে পারে। এছাড়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, গার্মেন্টসহ শিল্প-কারখানার বেতন-ভাতা বকেয়া থাকার কারণে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। সারা দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থা, মার্কেট, শপিংমল ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান করোনার কারণে বন্ধ থাকলে রমজানে সামাজিক অস্থিরতার নানারূপ সংকট সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা মহানগরীর সংস্কার এবং সড়ক পথে উন্নয়নমূলক কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরে চলছে। এতে জনদুর্ভোগ রয়েছে। এছাড়া ট্রেন, বাস এবং লঞ্চ-স্টিমারের টিকিট কালোবাজারি, পরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধি, যাত্রী হয়রানি চাঁদাবাজি, অজ্ঞানপার্টির তৎপরতার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিঘ্ন ঘটতে পারে। পবিত্র রমজানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যুতের লোডশেডিং হলে, গ্যাসের চাপ কম থাকলে এবং অপর্যাপ্ত পানি সরবরাহের ঘাটতি থাকলে জনদুর্ভোগ আরও বাড়বে। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকারবিরোধী অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘কোভিড-১৯ এর পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে হাইকোর্টের মাঠে জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে এবং বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদসহ ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন ঈদগাহ ও মসজিদে ঈদুল ফিতরের নামাজ অনুষ্ঠিত হবে। ঈদুল ফিতরের দিন জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে ঈদের জামায়াতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি উপস্থিত থাকবেন। সেখানে মন্ত্রী, এমপি এবং গুরুত্বপূর্ণ লাখো মুসল্লির সমাগম ঘটবে। স্বার্থান্বেষী মহল দেশের বর্তমান পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে জাতীয় ঈদগাহসহ ঢাকা মহানগরীর অন্য ঈদগাহে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঘটতে পারে।’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে শ্রমিকরা তাদের মজুরি না পেলে স্বার্থান্বেষী মহলের ইন্ধনে শিল্প প্রতিষ্ঠান ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, সড়ক অবরোধ, যানবাহন ভাংচুর এবং প্রতিষ্ঠানের মালিকের গাড়ি ঘেরাওসহ নানা ঘটনায় আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে। এছাড়া শ্রমিক ও মালিক পক্ষের মধ্যে বেতন-বোনাস নিয়ে সৃষ্ট অসন্তোষের সুযোগ নিয়ে অসৎ শ্রমিক সংগঠনের নেতারাও শ্রমিকদের উসকানি দিয়ে যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে পারে। এতে আরও বলা হয়, ‘লকডাউন পরিস্থিতিতে জনশূন্যতাকে পুঁজি করে বিভিন্ন অপরাধী চক্র এরই মধ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠেছে। তারা চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। ঈদে জাকাতের টাকা, কাপড়, খাবার ও ত্রাণ বিতরণকালে পদদলিত হয়ে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটতে পারে।’ প্রতিবেদনে ১০টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে ইফতার পার্টি, ধর্মীয় অনুষ্ঠান গণজামায়েত বন্ধ রাখতে হবে। ঢাকা মহানগরীতে ইফতারসামগ্রী বিক্রির ক্ষেত্রে সীমিত আকারে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে বিক্রি করার অনুমতি দেয়া যেতে পারে। গরিব, দুস্থ, অসহায়, বস্তিবাসী ও নিন্মআয়ের মানুষের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ইফতার সেহরির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সরকারের ঘোষণা ছাড়া কাঁচাবাজার ও খাবারের দোকান যেন খোলা না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। খোলাবাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপদ দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে। ত্রাণ নিয়ে যেকোনো অনিয়ম দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। এছাড়া অগ্রিম গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে সব গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সূত্র : যুগান্তর