ওজোপাডিকোর হাইভোল্টেজ ওভারহেড লাইনে বাড়ছে দূর্ঘটনা, ভূগর্ভে স্থানান্তরের দাবি
আল-আমিন|১৮:১৯, জানুয়ারি ২৮ ২০২৪ মিনিট
নিজেস্ব প্রতিবেদক : বরিশালে সড়কের উপরে থাকা ওয়েষ্ট জোন পাওয়ার ডিষ্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) উচ্চ ভোল্টেজ বহনকারী বৈদ্যুতিক লাইনে ক্রমশ বেড়েই চলেছে দূর্ঘটনা। সাধারণ জনগণের অসচেতনতা ও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় বৃদ্ধি পাচ্ছে হতাহতের সংখ্যা। সাধারন মানুষের জীবন নিয়ে ব্যবসা করলেও ভুক্তভোগীদের পাশে দাড়াচ্ছে না ওজোপাডিকো কর্তৃপক্ষ।
শুক্রবার (২৬ শে জানুয়ারি) সকাল ১১ টার দিকে বরিশাল নগরীর ভাটিখানা কাজি বাড়ি মসজিদ সংলগ্ন একটি বহুতল ভবনের ছাদে রড স্থাপনের সময়ে অসাবধানতা বসত রাস্তার উপরে থাকা ১১ হাজার ভোল্টেজের লাইনে দূর্ঘটনায় প্রাণ হারান শাহাবুদ্দিন মুন্সি নামের এক নির্মাণ শ্রমিক। নিহত শাহাবুদ্দিন বরিশাল সদর উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাহেবের হাট গ্রামের বাসিন্দা দুলাল মুন্সীর পুত্র।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়- নির্মানাধীন বহুতল ভবনের গা ঘেঁষেই ১১ হাজার ভোল্টেজের লাইন সংযোগ দিয়েছে ওজোপাডিকো কর্তৃপক্ষ। এর পাশেই ছাদের ভীম তৈরির কাজে রড স্থাপন করছিলেন শাহাবুদ্দীন মুন্সি। অসাবধানতা বসত তার হাতে থাকা রডের বর্ধিতাংশ উচ্চ ভোল্টেজ লাইনের কাছাকাছি পৌঁছাতেই ঘটে এই মর্মান্তিক দূর্ঘটনা।
এরআগেও নগরীর কাউনিয়া বিসিক রোড টেক্সটাইল মোড় সংলগ্ন একটি ভবনে কাজ করতে গিয়ে দূর্ঘটনার কবলে পরেন এক ওয়ার্কশপ মিস্ত্রি জাহিদুল ইসলাম ও তার সহযোগী। সে সময় প্রাণে বাঁচলেও সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় তাদেরকে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়- দূর্ঘটনার শিকার মিস্ত্রি জাহিদুল ইসলাম নগরীর ৩ নং ওয়ার্ডস্থ শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত কলেজ সংলগ্ন হাওলাদার বাড়ীর বাসিন্দা। দূর্ঘটনায় কেটে ফেলা হয়েছে তার উভয় হাতের কব্জি। দুই হাত হারিয়ে বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তিনি। চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে গিয়ে হারিয়েছেন নিজের সহায় সম্বল। রোজগার না থাকা ছেড়ে গিয়েছে প্রিয়তমা স্ত্রীও। খাওয়া থেকে শুরু করে সকল কাজের জন্য বৃদ্ধা মায়ের উপরে নির্ভরশীল তিনি। ওজোপাডিকো জনগণের অর্থে ব্যবসা করলেও কোন ধরনের সহোযোগিতার হাত বাড়ানো তো দূরের কথা কখনো খোঁজ খবরও রাখেনা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর। যা সম্পূর্ণ রূপে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল।
কয়েক বছর পূর্বে যানবাহন চলাচল, জনগণের যানমাল রক্ষা ও প্রাকৃতিক দূর্যোগের সময়েও নিরবিচ্ছিন্ন বৈদ্যুতিক সেবা প্রদানের লক্ষ্যে ‘পরিকল্পনা বিভাগের তত্তাবধানে’ ‘আন্ডারগ্রাউন্ড পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম প্রজেক্ট ইন ওয়েস্ট জোন এরিয়া’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিলো ওজোপাডিকো কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বিনিয়োগ সংকট, করোনা মহামারীর প্রভাবসহ নানা সমস্যার কারণে সেই প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ে।
বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি খুলনা, বরিশাল এবং যশোরে প্রায় ২ হাজার ৬১ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ লাইন স্থাপনে একটি পরিকল্পনা নিয়েছিলো। যার আনুমানিক খরচ ধরা হয়েছিল প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ন ও করনা মহামারীর প্রভাবে সে সময় মুখ থুবড়ে পড়েছিল প্রকল্পটি। সে সময় এডিবির অর্থায়নে ভারতীয় টাটা পাওয়ার কনসালটেন্ট ও বাংলাদেশের ইসিবিএল যৌথভাবে এ কাজের সমীক্ষা চালায়।
সেই সমীক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল- শহরের বেশ কয়েকটি এলাকা অত্যন্ত কোলাহলপূর্ণ, ঘন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ঘনবসতিপূর্ণ। এছাড়া শহরের সড়কগুলোও অত্যন্ত ছোট। যা মাটির নিচ দিয়ে বৈদ্যুতিক সংযোগ স্থাপনের জন্য সক্ষম নয়। পরবর্তীতে এডিবির অর্থায়নে পুনরায় ভারতের টাটা পাওয়ার কনসালটেন্ট সমীক্ষা চালালেও রিপোর্ট নেগেটিভ হওয়ায় বাতিল হয়ে যায় বরিশাল, খুলনা ও যশোরের ভূগর্ভস্থ লাইনের প্রকল্প।
উল্লেখ্য- সে সময়ে যশোরের সমীক্ষা রিপোর্টের উপরেই ভিত্তি করে কি বাতিল করা হয়েছিল বরিশাল ও খুলনার প্রকল্প? গুঞ্জন উঠেছে লাভ জনক না হওয়ার শঙ্কায় বাতিল করা হয়েছিল প্রকল্পটি।পরবর্তী সময়ে সাধারন মানুষের জীবন ঝুঁকিতে ফেলেই ব্যবসা শুরু করে ওজোপাডিকো। ২০-৩০ ফুট খুঁটির মাধ্যমেই বরিশাল নগরীতে ৩৩ হাজার ও ১১ হাজার ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক তার সংযোগ করে ওজোপাডিকো কর্তৃপক্ষ। যা স্থাপন করা হয়েছে নগরীর প্রায় বহুতল ভবনগুলোর গা ঘেষে। আর তাতেই ঘটছে একের পর এক দূর্ঘটনা । হতাহতের ৯৯ শতাংশই বহুতল ভবনে কাজ করতে আসা শ্রমিক যাদের অধিকাংশই ওভারহেড লাইন সম্পর্কে জ্ঞানহীন।
এ বিষয়ে বরিশাল ওজোপাডিকোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল মজিদ জানান, ওভারহেড লাইন ভূগর্ভস্থ করার বিষয়টি অনেক আগেই বাতিল হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের মৃত্যু হোক সেটা কাম্য নয়। অসচেতনতার কারনেই ঘটছে একাধিক দূর্ঘটনা। ১১ কেভি লাইনের পাশে বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের কথাও জানান এই কর্মকর্তা।
প্রকল্প লাভজনক না হওয়াতেই সাধারণ মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন- বিনিয়োগের অভাবেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবলের কাজ।
অপরিকল্পিত নগরায়নের প্রভাব ও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় বেড়েই চলেছে দূর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা। জনগনের স্বার্থ রক্ষায় ওভারহেড লাইন ভূগর্ভস্থ করার বিকল্প কিছুই নেই। ওভারহেড লাইনের বিষয়ে জনগনকে সচেতন করতে উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি বিভিন্ন সচেতনতা মূলক প্রচারণা চালানো উচিৎ কর্তৃপক্ষের। একই সাথে উচ্চ ভোল্টেজের ওভারহেড লাইনের এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিভাগের নিয়মাবলী অনুকরণের পরামর্শ দিচ্ছেন একাধিক নগর বিশ্লেষকর।
প্রাকৃতিক দূর্যোগের সময় নিরবিচ্ছিন্ন বৈদ্যুতিক সেবা নিশ্চিত করতে ও জানমালের ক্ষয়ক্ষতি রোধে ওভারহেড বৈদ্যুতিক লাইন ভূগর্ভস্থ করার দাবি বরিশালবাসীর।