প্রচার মাইকের উচ্চ শব্দে অতিষ্ঠ নগরবাসী

নিজেস্ব প্রতিবেদক | ২২:১২, মে ২৮ ২০২৩ মিনিট

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ আসন্ন বরিশাল সিটি নির্বাচনকে ঘিরে প্রার্থীদের নির্বাচনি প্রচার এখন তুঙ্গে। মেয়র পদে ৭ জন এবং ৩০টি ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১১৬ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৪২ জন প্রার্থীর চলছে প্রচারযজ্ঞ। নিয়মনীতির ধার ধারছেন না কেউ। ব্যবহার করা হচ্ছে খুবই উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন শব্দযন্ত্র। বিশেষ লম্বাকৃত এই মাইক বা শব্দযন্ত্রের অওয়াজ এতটাই বিকট, এর পাঁচশ’ হাতের মধ্যে কোন মানুষের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে এই শব্দ শ্রবন করা সম্ভব নয়। দুপুর দুইটার পরেই মাইকে শুরু হয় প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণা। চলে টানা রাত ৮টা পর্যন্ত। মেয়র, সাধারণ কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলরদের নানা গুণগান সমৃদ্ধ স্লোগান প্রচার করা হয় মাইকে। কেউ নিজের কণ্ঠেই বলে যাচ্ছেন, কেউ আবার রেকর্ড করা স্লোগান ছেড়ে দিচ্ছেন। স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, বাজার, মসজিদ-মন্দির ও আবাসিক এলাকাসহ সবখানেই প্রার্থীদের পক্ষে মাইকিং চলছে। এমনকি যানজটে দাঁড়ানো অবস্থাতেও থামছে না মাইকের শব্দ। মাইকের এমন বিকট শব্দে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন নগরবাসী। গত ২৬ মে প্রতীক বরাদ্দের পর থেকেই শুরু হয় এমন প্রচারণা। সিটি করপোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা ২০১৬-তে মাইক্রোফোন ব্যবহার সংক্রান্ত বাধা-নিষেধে বলা হয়েছে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বা তার পক্ষে কোনও রাজনৈতিক দল, অন্য কোনও ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান একটি ওয়ার্ডে পথসভা বা নির্বাচনি প্রচারের কাজে একের অধিক মাইক্রোফোন বা শব্দের মাত্রা বর্ধনকারী অন্যবিধ যন্ত্র ব্যবহার করতে পারবেন না। কিন্তু সরেজমিনে দেখা যায়, প্রার্থীদের প্রচারের মাইক নগরীর বিভিন্ন অলিগলিতে উচ্চস্বরে বাজতে থাকে। কেউ কেউ উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সাউন্ড-স্পিকারও ব্যবহার করছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনও প্রার্থীর বিরুদ্ধে তেমন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি নির্বাচন কমিশন বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে কমপক্ষে ৪ জন করে প্রার্থী রয়েছেন এবং প্রত্যেক কাউন্সিলর প্রার্থী কমপক্ষে দুটি করে মাইক ব্যবহার করছেন। ফলে প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রার্থীদের সংখ্যার দ্বিগুণের চেয়ে বেশি শব্দ দূষণকারী মাইক বা যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। ঠিক দুপুর ২ টার সময় থেকেই প্রার্থীদের সর্মথকেরা মাইকে প্রচারণার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেন। অনেক সময় ভিন্ন ভিন্ন প্রার্থীদের একই সড়কে অটোরিকশায় ৭-৮টি প্রচারণার মাইক চলে। জনসাধারণকে শব্দে অতিষ্ঠ হয়ে ওই সময়টুকু দুই হাত দিয়ে কান চেপে ধরতে দেখা গেছে। শহরের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে পথচারীরাও উচ্চ শব্দের যন্ত্রণা ভোগ করছেন। বাসা বাড়িতেও শিশু ও বয়স্কদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মাইকের উচ্চ শব্দ। শহরের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, শহরে দুপুর থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত প্রতিদিন উচ্চ শব্দে মাইক বাজিয়ে প্রার্থীদের নানা প্রচারণা চালানো হয়। ফলে রাস্তার পাশে থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, হাসপাতাল, অফিস, ব্যাংক-বিমার দাপ্তরিক কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ এ ‘নীরব’, ‘আবাসিক’, ‘মিশ্র’, ‘বাণিজ্যিক’ ও ‘শিল্প’ এ পাঁচটি এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিধিমালায় নীরব এলাকায় দিনে ৫০ ডেসিবল ও রাতে ৪০ ডেসিবল, আবাসিক এলাকায় দিনে ৫৫ রাতে ৪৫, মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০, রাতে ৫০, বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০, রাতে ৬০ ও শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ রাতে ৭০ ডেসিবল শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। কিন্তু বরিশাল সিটির নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রচার মাইকে এ নিয়মন মানা হচ্ছে না। মাইকে সর্বোচ্চ শব্দ দিয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এতে একদিকে বিরক্তি অন্যদিকে কানে সমস্যা দেখা দিতে পারে জনসাধারণের। শহরের ব্যবসায়ী মনির হোসেন বলেন, প্রতিদিন প্রধান সড়ক দিয়ে ৭-৮টি মাইক উচ্চ শব্দে প্রচারণা চালায়। অনেক আবার গান বাজিয়ে প্রার্থীদের নানা স্লোগান দেন। দুপুর থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত মারাত্মক যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে। কাউকে বলেও লাভ নেই, এ বিষয়ে কেউই গুরুত্ব দিচ্ছে না। হাসপাতাল রোডের বাসিন্দা মোশারেফ হোসেন বলেন, প্রার্থীদের প্রচার মাইক হাসপাতালের সামনে দিয়ে গেলেও থামে না। শব্দ দূষণে আমরাই অতিষ্ঠ, রোগীদের অবস্থা আরো খারাপ হতে পারে। বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী মাইশা জানায়, মাইকের উচ্চ শব্দের কারণে পড়ালেখায় বিঘœ ঘটছে। সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। দুপুরের পর থেকে শব্দে কান ফেটে যায়। এ ব্যাপারে একাধিক প্রার্থী জানান, প্রতিটি ওয়ার্ডে কমপক্ষে পাঁচ থেকে সাতজন কাউন্সিলর প্রার্থী ও সাতজন মেয়র প্রার্থীর প্রচারণা চলছে। কম করে হলেও ১০-১৫টি মাইক একই ওয়ার্ডের বিভিন্ন সড়কে বিকট শব্দে প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছে। শব্দ নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা বলা হলেও যিনি মাইকিংয়ের দায়িত্বে থাকেন, তাঁর ইচ্ছার ওপর নিভর করে কতটুকো শব্দ ব্যবহার করা হবে। তবে নিয়ন্ত্রিত শব্দ দিয়ে প্রচারণা চালানোর কথা জানিয়েছেন কয়েকজন প্রার্থী। বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালের এক চিকিৎসক চিরঞ্জিত সিনহা বলেন, নিয়মিত শ্রবণে সাধারণত ৬০ ডেসিবল শব্দের তীব্রতায় মানুষ সাময়িক বধির ও ১০০ ডেসিবল স্থায়ী বধির হয়ে যেতে পারে। মাইকিংয়ের শব্দ মানুষের মস্তিষ্কে আঘাত করে। এতে শ্রবণশক্তি হ্রাস ছাড়াও হৃদরোগের ঝুঁকি থাকে। তবে শব্দদূষণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। শব্দদূষণ তিন বছর বা তার কম বয়সী শিশুদের মানসিক বিকাশের অন্তরায়। এ ব্যাপারে নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ‘প্রার্থীদের নির্বাচনী আচরনবিধি মেনে চলার আনুরোধ জানিয়ে প্রচার-প্রচারণার সময়সীমা বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। নীতিমালার চেয়েও প্রার্থীদের কাছে ভোটারের পছন্দ অপছন্দ বিবেচনা করতে হবে। উচ্চ শব্দ সবার জন্যই ক্ষতিকর। আমাদের ভ্রাম্যমাণ টিম রয়েছে মাঠে, তাঁরা প্রয়োজনে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পারেন। উল্লেখ্য, আগামী ১২ জুন নগরীর ১২৬টি কেন্দ্রের ৮৯৪টি কক্ষে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ৫৮ বর্গকিলোমিটার নগরীতে মোট ভোটার ২ লাখ ৭৬ হাজার ২৯৮ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮০৯ জন এবং পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৩৭ হাজার ৪৮৯ জন।