বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে দালাল দৌরাত্ম্য
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ ২৫০ শয্যা বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে দালালদের কারসাজি নতুন নয়। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে, তাদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। দালালরা ছাড়াও প্রতাপ দেখাচ্ছে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি প্রতিনিধিরা।
রোগীদের কাছে তারা ত্রাস। যে কারণে হাসপাতালের পরিবেশ-পরিস্থিতি চরম অস্বস্তিকর হয়ে উঠছে। হাসপাতালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চিকিৎসকের কক্ষের দরজায় লেখা- ‘সকাল সাড়ে ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত কোনো ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির দেখা করা নিষেধ।
যদিও এমন কোনো নিয়ম কোনো কোম্পানির জন্য বর্তায় না। কিন্তু বরগুনা জেনারেলে তার বালাই নেই। কোনো প্রতিনিধি নিয়ম মানেন না। ডাক্তার দেখিয়ে রোগী বের হলেই তার ব্যবস্থাপত্র নিয়ে চলে টানা হেঁচড়া। অনেক সময় দেওয়া হয় হুমকি। এতে ভয়-ভোগান্তি দুটোই পোহাতে হয় সেবাগ্রহীতাদের।
বর্তমানে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে রোগীর চাপ অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি। তাই প্রতিটি বিভাগের সামনে অপেক্ষা করে থাকে দালালরা। সঙ্গে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি। বহির্বিভাগের মেডিসিন ও সার্জারি বিভাগের সামনে সবচেয়ে বেশি দালাল ও প্রতিনিধি দেখা যায়।
জানা গেছে, দালালরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন রোগীদের ভিন্ন ভিন্ন অসুখের জন্য ভর্তি বাণিজ্য, অপারেশন, ওষুধ কেনাসহ প্রতারণা করে থাকে। এ ছাড়া সরকারি হাসপাতালে না নিয়ে রোগীদের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়ার অভিযোগও আছে তাদের বিরুদ্ধে।
কয়েক দলে ভাগ হয়ে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরাও রোগী বা তাদের স্বজনদের জেঁকে ধরেন। রোগীদের ব্যবস্থাপত্রের ছবি তুলে নিয়ে যান। স্বল্প মূল্যে ওষুধ কেনার জন্যও তারা প্ররোচিত করেন।
চিকিৎসকদের চেম্বারের বাইরে রোগীদের চেয়ে এসব দালাল-প্রতিনিধির আধিক্য বেশি। চেয়ারগুলোও তাদের দখলে।
হাসপাতালের চিকিৎসকদের উৎকোচ দেওয়ার অভিযোগও আছে ব্যাপক। সরেজমিনে হাসপাতালের অবস্থা পর্যবেক্ষণের সময় মামুন ও তন্ময় নামে পপুলার ফার্মাসিটিক্যাল লিমিটেডের দুই তথ্য কর্মকর্তাকে দেখা যায় রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে তাদের কোম্পানির ওষুধের নাম লেখাতে চিকিৎসকের জন্য উৎকোচ নিয়ে এসেছেন। এ সময় তাদের গরায় কোম্পানির পরিচয় পত্রও ছিল। হাসপাতালে সাংবাদিকের উপস্থিতি জানতে পেরে পরে তারা দৌড়ে পালান।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানকে দালাল ও কোম্পানির প্রতিনিধিমুক্ত করতে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তার একটি ‘অফিস আদেশ’। এতে পরিষ্কারভাবে লেখা- চিকিৎসকরা সকাল ৮টা ৩০ মিনিট থেকে দুপুর ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির সাক্ষাত গ্রহণ করবেন না। অতএব, সকল পর্যায়ে কর্মরত ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের সকাল থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত হাসপাতাল প্রাঙ্গণে অবস্থান না করার জন্য বলা হলো। গত ২৯ অক্টোবর এ নোটিশ ঝোলানো হলেও থোড়াই কেয়ার করেন প্রতিনিধিরা।
হাসপাতাল দালালমুক্ত করার কথা বলা হলেও প্রতিনিয়ত দালাল যুক্ত হচ্ছে বরগুনা জেনারেলে। তারা বিভিন্ন রোগীর ব্যবস্থাপত্র, এক্সরে, বিভিন্ন পরীক্ষার ব্যবস্থাপত্র নিয়ে স্বজনদের প্ররোচিত করে বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। রোগী বা স্বজনরা কোনো সময় রাজি না হলে ভয়-ভীতি দেখানো হয়। হুমকিও দেওয়া হয়।
আক্ষেপ প্রকাশ করে এক রোগী বলেন, ডাক্তার দেখাতে এসে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকি। এরমধ্য বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির লোকজন ডাক্তারের রুমে এসে অনেক সময় নষ্ট করে। এতে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছি। প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলে আমাদের রোগ সম্পর্কে জেনে যায়। বার বার না করলেও তারা জোর করে। নারী-পুরুষ সবাইকে বিরক্ত করে।
আরেক রোগীর স্বজন বলেন, হাসপাতালের দালালরা আমাদের বিভিন্ন সময় হয়রানী করে। তারা অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। গালাগাল দেয়, হুমকি দেয়। সরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে এসে এমন বিব্রতকর অবস্থায় পড়লে আমাদের যাওয়ার জায়গা কোথায়। অর্থ-সম্পদ থাকলে তো আর সরকারি হাসপাতালে আসতাম না।
বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ অ্যাসোসিয়েশন (ফারিয়া) বরগুনা জেলা শাখার সভাপতি মহাসিন খান বলেন, বরগুনা জেনারেল হাসপাতাল থেকে টাইম নির্ধারণ করে দিয়েছি ডাক্তার ভিজিট করার জন্য। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সাক্ষাতের অনুমতি আনা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে কোনো কোম্পানির লোক ডাক্তারদের সাথে সাক্ষাৎ করলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
২৫০ শয্যা বরগুনা জেনারেল হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. সোহরাব উদ্দীন এসব ব্যাপারে বলেন, ওরা (ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি) ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে ভিড়-জটলা করে। এতে তো অবশ্যই সমস্যা হয়। এ ছাড়া আরও যে সমস্যা রয়েছে- সেসব ব্যাপারে জেলা প্রশাসককে (ডিসি) চিঠি দেওয়া হয়েছে। তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন।