আবারও ফেরত কুয়াকাটা সৈকত রক্ষা প্রকল্প

দেশ জনপদ ডেস্ক | ১৮:৩৬, নভেম্বর ১২ ২০২২ মিনিট

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ হুমকির মুখে থাকা কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া প্রকল্প আবারও ফেরত পাঠিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। এ নিয়ে তিনবার এই প্রকল্প ফেরত পাঠানো হলো। প্রথম দুবার প্রকল্প প্রস্তাবে ত্রুটি থাকার কথা বলেছিল কমিশন। এবার তারা বলছে, আর্থিক সংকটের কথা। সংকটের কারণে কৃচ্ছ সাধনের দোহাই দিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ তালিকায় ঢুকিয়ে ফেরত দেওয়া হয়েছে প্রকল্পটি। অথচ টানা ২০ বছর ধরে অব্যাহত সাগর ভাঙনে মারাত্মক হুমকির মুখে এ সৈকত। ইতোমধ্যে বিলীন হয়েছে ইকোপার্কসহ সাগর পাড়ের সরকারি-বেসরকারি কয়েকশ স্থাপনা। লোকালয়ের ৩ কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে পড়া সাগর এখনো ভেঙে নিচ্ছে হোটেল-মোটেলসহ বহু অবকাঠামো। খ্যাতনামা এই সৈকত রক্ষায় নেওয়া প্রকল্প কি করে কম গুরুত্বপূর্ণ-সেই প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটন ব্যবসায়ীরা। ২০ বছর ধরে জনপদে ঢুকছে সমুদ্র : ‘কুয়াকাটায় এখন যেখানে সমুদ্র, সেটি ছিল আরও ২ থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে। বেড়িবাঁধ থেকে হেঁটে সৈকতে পৌঁছতে সময় লাগত প্রায় আধা ঘণ্টা। আর এখন সেই বেড়িবাঁধ রক্ষার চেষ্টা চলছে। মাত্র ২০-২২ বছরে বিশাল এলাকা গিলে খেয়েছে সাগর। বর্তমানে যে পরিস্থিতি তাতে আসছে বর্ষায় বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে সাগর ঢুকে পড়ার শঙ্কায় সবাই।’ হতাশার সুরে কথাগুলো বলছিলেন কুয়াকাটার বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা হাজী আব্দুস সাত্তার ফরাজী। ৬ যুগেরও বেশি সময় ধরে যিনি দেখছেন সাগর ভাঙন। শুধু সাত্তার ফরাজীই নন, সমুদ্রের উন্মত্ত ঢেউয়ে বিলীন হতে থাকা সাগর পাড়ের স্থাপনাগুলো ভয় জাগাচ্ছে সবার মনে। বিশেষ করে দুশ্চিন্তায় পর্যটন বাণিজ্যে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা ব্যবসায়ীরা। হোটেল মালিক সোহেল আহম্মেদ বলেন, ‘এখানে কিন্তু সাগর ভাঙে না, ঢেউ এসে ধুয়ে নেয় তীর। এভাবে ধুয়ে ধুয়ে ঢোকে জনপদে। ১০-১২ বছর আগে যখন ব্যবসা শুরু করি সমুদ্র ছিল অনেক দূরে। মাত্র ক’বছরের ব্যবধানে তা এখন ঘরের দরজায়। সৈকতের পশ্চিম প্রান্তে নতুন বেড়িবাঁধ-রিংবাঁধ করেও সামাল দেওয়া যায়নি কিছুই। সবই গিলে খেয়েছে সমুদ্র। আগে জোয়ারের সময় হেঁটে বেড়ানো যেত ১২ কিলোমিটার সৈকত। এখন ভাটিতেও অনেক জায়গা থাকে পানির নিচে।’ স্থানীয় উদ্যোক্তা খলিল শরীফ বলেন, ‘বরিশাল-কুয়াকাটা সড়কে ছিল ৬টি ফেরি। সেসব জায়গায় ব্রিজ হয়েছে। পদ্মা সেতু চালুর পর রাজধানী থেকে মাত্র ৫-৬ ঘণ্টায় পৌঁছানো যাচ্ছে কুয়াকাটা। ফলে বহুগুণ বেড়েছে পর্যটকদের আগমন। দিন দিন যেখানে সম্ভাবনা বাড়াচ্ছে কুয়াকাটা সেখানে আমরা শঙ্কিত সৈকতের অস্তিত্ব নিয়ে। যেভাবে রাক্ষসের মতো এগোচ্ছে সাগর তাতে সবই এখন বিলীনের পথে।’ আবারও ফেরত এলো সৈকত রক্ষা প্রকল্প : কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত রক্ষায় ২০১৮ সালে প্রথম প্রকল্প প্রস্তাব পাঠায় স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। ৬৪৫ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষে ওই প্রকল্পে মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণসহ সৈকত রক্ষায় নানা কর্মকাণ্ডের কথা বলে তারা। প্রস্তাবে ত্রুটির কথা উল্লেখ করে তা ফেরত পাঠায় পরিকল্পনা কমিশন। ২০২১ সালের অক্টোবরে দ্বিতীয় দফায় ৯৫৬ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ আরেকটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয় কমিশনে। এবারও সংশোধন-সংযোজনের কথা বলে তা ফেরত পাঠানো হয়। সর্বশেষ চলতি বছর ১ হাজার ২১১ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ তৃতীয় দফায় আরেকটি প্রকল্প কমিশনে জমা দেয় পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের আওতায় ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকতে ভাঙন প্রতিরোধ ছাড়াও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ, মেরিন ড্রাইভ, বনায়ন, লাইফ গার্ড স্টেশন, পাবলিক টয়লেট, অটোমোটেভ লকার ও একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব দেয় তারা। এবার প্রকল্পটিকে কম গুরুত্বপূর্ণ আখ্যা দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। ৫ নভেম্বর  দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পরিকল্পনা সচিব মামুন আল রশিদ বলেন, ‘বর্তমানে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি অনুকূলে নয়। অর্থ সংকটের কারণে কৃচ্ছ সাধনের নির্দেশনা রয়েছে সরকারের। খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলে নতুন কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে না। সবকিছু মিলিয়ে প্রস্তাব ফেরত দেওয়া হয়েছে।’ পরিকল্পনা কমিশনের আচরণে ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা : ২০-২২ বছর ধরে এভাবে সমুদ্র এগোলেও তা প্রতিরোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষুব্ধ কুয়াকাটার মানুষ। সর্বশেষ প্রকল্প প্রস্তাব ফেরত আসায় সেই ক্ষোভ বেড়েছে বহুগুণ। ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটার সভাপতি রুম্মান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, ‘বহু বছর ধরেই জনপদের দিকে এগোচ্ছে সাগর। বর্তমানে যে পরিস্থিতি, তাতে আসন্ন বর্ষায় সাগর পাড়ে বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা হোটেল, মার্কেট এবং শুঁটকি বাজারসহ আরও অন্তত হাজারখানেক স্থাপনা বিলীন হওয়ার পথে। এটি ঠেকাতে বালুর বস্তা ফেলাসহ কিছু কাজ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু বালুর বাঁধ দিয়ে তো আর সাগর ঠেকানো যায় না। এই যখন পরিস্থিতি তখন কেন ফেরত পাঠানো হলো সৈকত রক্ষা প্রকল্প? তাহলে কি তারা চান না যে টিকে থাকুক কুয়াকাটা?’ হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ বলেন, ‘সরকারের এমন কোনো মন্ত্রণালয়-দপ্তর নেই যেখানে আবেদন করিনি। সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়ন ও পদ্মা সেতু চালু হয়েছে। সবমিলিয়ে ক্রমেই বাড়ছে সৈকতের সম্ভাবনা। বড় বড় ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করছেন। সরকারের কাছে প্রশ্ন, কুয়াকাটা রক্ষা কি কম গুরুত্বপূর্ণ? প্রধানমন্ত্রী নিজে এ কুয়াকাটার উন্নয়ন নিয়ে বহুবার কথা বলেছেন। তারপরও এটি ফেরত পাঠানো হলো কেন?’ কুয়াকাটার পর্যটন উদ্যোক্তা হাসনুল ইকবাল বলেন, ‘প্রকল্প প্রস্তাব ফেরত পাঠানোর বিষয়টি সত্যিই দুঃখজনক। অর্থনীতি সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা রাখা কুয়াকাটা সৈকত রক্ষা কম গুরুত্বপূর্ণ হয় কি করে? আমি এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’