শুঁটকিতে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন বুনছেন উপকূলবাসী
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ গুণগতমান বজায় রেখে সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে শুঁটকি উৎপাদনের শপথ নিয়েছেন উপকূলীয় জেলা বরগুনার তালতলীর আশার চরের জেলেরা। এই মৌসুমে মাছ শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি হয় সবচেয়ে বেশি। তাই এখন যেন এখানকার বাসিন্দাদের দম ফেলারও ফুরসত নেই।
উপকূলীয় জেলার তালতলী উপজেলার আশারচর, সোনাকাটা, জয়ালভাঙ্গা চরে এখন শুঁটকি তৈরির ভরা মৌসুম। শুঁটকি পল্লিতে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত পাঁচ মাস ধরে চলে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ। যেখানে প্রায় ১০ হাজার জেলে দিনরাত কাজ করেন। তাদের সঙ্গে কমপক্ষে ৩-৪ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। এই সময়গুলোতে সরব থাকে শুঁটকি পল্লির ক্রেতা, বিক্রেতা ও শ্রমিকরা। প্রতিটি শুঁটকি পল্লি থেকে প্রতি সপ্তাহে অন্তত ১০০ থেকে ১৫০ মণ মাছ রপ্তানি হয়।
নদী থেকে কাঁচা মাছ শুঁটকি পল্লিতে নিয়ে আসার পর নারী শ্রমিকরা সেগুলো পরিষ্কার করেন। এরপর মাছগুলো পরিস্কার পানিতে ধুয়ে বানায় (মাচা) শুকানো হয়। তিন-চার দিনের রোদে মাছগুলো শুকিয়ে শক্ত হয়। প্রস্তুত থাকে ক্রেতা, পাইকার ও ব্যবসায়ীরা। এই চরের শুঁটকি চট্টগ্রাম, সৈয়দপুর, খুলনা ও জামালপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান হয়। প্রস্তুত করার সময় কোনো প্রকার কীটনাশক বা অতিরিক্ত লবণ দেওয়া হয় না বলে এই এলাকার শুঁটকির চাহিদা একটু বেশি থাকে।
বর্তমানে প্রতি কেজি ছুরি মাছের শুঁটকি ৭০০-৮০০ টাকা, রূপচান্দা ১ হাজার থেকে দেড় হাজার, মাইট্যা ৮০০ থেকে এক হাজার, লইট্যা ৬০০ থেকে ৭০০, চিংড়ি ৭০০ থেকে ৯০০ এবং অন্যান্য ছোট মাছের শুঁটকি ৩০০ থেকে ৫৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আশারচর শুঁটকি পল্লিতে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ৬ শতাধিক জেলে ও মালিক শুঁটকি উৎপাদন করার লক্ষে ছোট ছোট ৩২টি ঘর তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কেউ কেউ ঘর উঠিয়ে মাছ রোদে শুকাচ্ছেন। একের পর এক মাছ ধরা ট্রলার সমুদ্র থেকে আসছে, আর সেই মাছগুলো প্রস্তুত হচ্ছে শুটকি বানানোর জন্য।
প্রায় ২৫ প্রজাতির মাছের শুঁটকি তৈরি করা হয় এখানে। এর মধ্যে রূপচাঁদা, ছুরি, কোরাল, সুরমা, লইট্টা ও পোপা অন্যতম। এছাড়াও চিংড়ি, ছুড়ি, ভোল, মেদসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছেরও রয়েছে অনেক চাহিদা। যেসব জেলেদের ঘর উঠানো হয়েছে তারা মাছগুলো বাঁশের মাচায় ও মাদুরে করে রোদে শুকাতে শুরু করেছেন।
এদিকে বর্ষার কয়েকমাস ছাড়া বছরের বাকি সময়ে মোটামুটি হলেও সবচেয়ে বেশি শুঁটকি তৈরি হয় শীতে।
এছাড়া এখানকার শুঁটকি মাছের গুড়ি সারাদেশে পোল্ট্রি ফার্ম ও ফিস ফিডের জন্য সরবরাহ হয়ে থাকে।
এদিকে দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতিসহ ডিজেলের দাম বেশি থাকায় চিন্তায় পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। এই ব্যবসায় বেশি লাভ থাকলেও এ বছর তেমন একটা হবে না বলে জানান জেলেরা।
স্থানীয় একাধিক জেলে ও ব্যবয়ারী বলেন, প্রাধান সড়ক থেকে শুটকি পল্লি পর্যন্ত এক কিলোমিটার রাস্তাটা খুবই খারাপ। এই রাস্তাটা ঠিক হলে আমরা শুটকিগুলো সরাসরি ট্রাকে লোড দিতে পারবো। এতে পরিবহন খরচ কম হবে। এছাড়া এখানে টয়লেট ও বিশুদ্ধ পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। টিউবওয়েল ও টয়লেট নির্মাণ করে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান তারা। ব্যবসায়ীরা আরও বলেন, আমরা প্রতি বছর এখান থেকে অনেক টাকা রাজস্ব দেই সরকারকে।
শুঁটকি ব্যবসায়ী মো. রুপচাঁন হাওলাদার বলেন, শুঁটকি তৈরি করার আগেই এখান থেকে সরকারিভাবে এসব শুঁটকি বিদেশে রপ্তানির উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক। কারণ দেশ থেকে সরকারিভাবে শুঁটকি রপ্তানির কোনো ব্যবস্থা নেই।
তিনি আরও বলেন, ছোট বেলা থেকেই এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাই অন্য পেশায় যাইতে পারি না। এখন বাজারে সবকিছুর দাম বেশি থাকায় এ বছর ব্যবসা কেমন হবে তা নিয়ে চিন্তায় আছি।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মাহবুবুল আলম বলেন, সরকারিভাবে শুঁটকি রপ্তানির জন্য মৎস্য অধিদফতরে সুপারিশ পাঠানো হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এসএম সাদিক তানভীর বলেন, এডিপি বা অন্য কোনো প্রকল্প থেকে রাস্তাটি দেওয়ার জন্য চেষ্টা করা হবে। এছাড়া বিশুদ্ধ পানির জন্য টিউবওয়েল ও টয়লেটের ব্যবস্থা করা হবে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব বলেন, বরগুনার তালতলীর আশার চরে শুঁটকি পল্লিতে বিভিন্নভাবে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তাই জেলে ও ব্যবসায়ীরা যাতে নির্বিঘ্নে ব্যবসা করতে পারেন সে জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।