নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ শান্তির নগরী হিসেবে পরিচিত বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে একটি ওয়ার্ড ৫ নং পলাশপুর। শহরের অধিকাংশ অপরাধীরা এখানেই এসে অবস্থান করে। গুচ্ছগ্রাম এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় এখানের অপরাধীদের সহজেই চিহ্নিত করা যায় না। এই ওয়ার্ডে বসবাসকারীদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষই বহিরাগত। এখানে নিন্ম আয়ের মানুষের বসবাসই বেশি। অভাব অনটন তাদের নিত্য দিনের সঙ্গি। তাদের এই অভাবকে পঁজি করে এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি সার্থ হাসিল করতে তাদের ব্যবহার করে থাকেন। তাদের দিয়ে করানো হয় মাদক বিক্রি, ছিনতাই, খুন, অস্ত্র পরিবহন, চুরি, ডাকাতি, প্রভাব বিস্তার সহ নানা অনৈতিক কর্মকান্ড।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের বর্তমান পুলিশ কমিশনার বরিশালে যোগদানের পর থেকেই অপরাধকে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। কিন্তু এই অপরাধের ধারা অব্যাহত রেখেছে পলাশপুর ৬ নাম্বারের একটি কিশোর গ্যাং। যারা অটোগ্রুপ নামেই পরিচিত। কারন এই গ্যাং এর অধিকাংশ সদস্য অপরাধ সংগঠিত করে অটো রিকসার মাধ্যমে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এর আগে বিভিন্ন স্থান থেকে ভাঙ্গারী মালামাল টোকানোর কাজ করতো আবার কেউ কেউ বাদামসহ ভ্রাম্যমান ফেরিওয়ালার কাজ করতো।
এখন দিনের বেলা থ্রী-হুইলার বা অটো চালিয়ে রাতে মাদক বিক্রি, ছিনতাই, অস্ত্র পরিবহন, চুরি ও ডাকাতি সহ অন্যান্য অপরাধ সংগঠিত করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অটো গ্যাং এর সদস্যা প্রায় ২০ জনের অধিক।
তবে সরেজমিনে অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৪জনের নাম। যারা এই গ্যাং এর মদদ দাতা বা প্রতিষ্ঠাতা। এই গ্যাং এর সদস্যরা হলেন, গোদা বেল্লাল, সাজ্জাদ, জামাত লাদেন, দাও ইমাম, টেনিস তুহিন, লিয়ন, সৈকত, খুর মুকুল, আসিক, বাপ্পি, ফয়সাল, সুজন, রিপন, জুম্মানসহ আরো ৮ জন। এই অটো গ্যাংয়ের নেতৃত্রে থাকা মূল হোতারা রয়েছে পর্দার আড়ালে। জানা যায়, এই মূল হোতারা অর্থের বিনিময়ে প্রশাসনিক সকল মামলা থেকে এদের বাঁচিয়ে রাখে। তবে প্রকাশ্যে এই গ্যাং এর নেতৃত্র্যে দেয় গোদা বেল্লাল, সাজ্জাদ ও জামাত লাদেন। বরিশাল মহানগরীসহ আশে পাশের এলাকায় যত চুরি হয় এর ৭৫% এই গ্যাং এর সদস্যরা করে থাকে। রাত ১২ টা থেকে ভোর পর্যন্ত এদের খপ্পরে পরে সর্বস্ব হারিয়েছে অনেক সাধারন মানুষ। কেউ বা হারিয়েছে অঙ্গ!
এমনি ঘটনা আমাদের চোখে পরে গত ২৭ অক্টোবর ভোরে। বরিশাল ঘাট থেকে যাত্রী নিয়ে রুপাতলীর পথে রওনা দিয়েছে সাজ্জাদ নামে এক যুবক। তার গাড়িতে যাত্রী হিসেবে গোদা বেল্লাল ও ইমাম নামে অপর ২ সদস্য। বরিশাল শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত স্টোডিয়ামের আগের অন্ধকার জায়গায় নামিয়ে দেয় মহিলা ও পুরুষ ২ জনকে। আমরা কাছে যেতেই দেখলাম মহিলার কানের লতী ছিড়ে গেছে! জিজ্ঞেস করতেই সে জানালো অটোতে থাকা লোক গুলো কানে থাকা সর্ণের জিনিস টান দিয়ে নিয়ে গেছে। তার এমন কথা শুনে আমরা অটোর পিছু নেই। অটোর পিছু নিয়ে সিএন্ডবি রোড হয়ে পলাশপুর ৬ নাম্বারে পৌঁছে ৪ জনকে দেখতে পাই আমরা এবং অটোর গায়ে নাম্বার লিখে নেই। যার নাম্বার ৮৮৮০০। পরের দিন সেই নাম্বার ধরে অটো খুঁজে পাই। তখন ৩ জনকে অটোতে দেখে চায়ের দোকানে জিজ্ঞেস করে তাদের নাম পাই। আর এই সূত্র ধরেই খুঁজে পাই এই অটো গ্যাং এর অস্তিত্ব।
জানা যায়, তাদের মাদকের খুচরা বিক্রেতা খুর মুকুল। বেলতলা খেয়াঘাটের আগে ৪ রাস্তার মোড়ের কাছে সেলুন রয়েছে এই মুকুলের। আর সেই সেলুনের আড়ালে গাঁজা ও ইয়াবা বিক্রি করে সে। এই বিক্রিত মাদকের সমান ভাগ পায় অন্য ২০ সদস্যরা। চলতি বছরে লঞ্চে যে হত্যাকান্ড ঘটেছে তাও এই গ্যাংএর মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়। এই গ্যাং এর সদস্যদের ইভটিজিংয়ের কারনে জ্ঞানের আলো নিভে গেছে অনেক মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের। অনেকে হারিয়েছেন সম্ভ্রম।
ছদ্দনাম (সুমি) দলীল উদ্দিন স্কুলের পাসে ভাড়া থেকে ভার্সিটির ভর্তি পরিক্ষার প্রস্ততি নিচ্ছিলেন। পরিচয় হয় সাজ্জাদের সাথে। তাকে ঘোরার কথা বলে সুন্দরবন ঢগের পরবর্তী অংশে নদীর পারে নিয়ে সাজ্জাদ, বেল্লাল, টেনিস তুহিন, সুজন মিলে গণধর্ষন করেন, কিছুদিন অসুস্থ থাকার পরে গ্রামের বাড়ী বাউফলে চলেজায় সে। কিন্তু ওই কিশোর গ্যাং এর হুমকির জন্য কারও কাছে মুখ খুলেনি বলে আমাদের জানিয়েছেন স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি। এই গ্যাং এর সদস্যদের অন্য ভাবে ব্যাবহার করে পর্দার আড়ালে থাকা দাদা নামে কিশোর গ্যাং লিডাররা। তাদের নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে ভদ্র সমাজের ব্যাক্তিদের উপরে কোন কারন ছাড়াই হামলা করা তাদের নিত্য দিনের ব্যাপার। বিএনপির জ্বালাও পোরাও এর সময় এই কিশোর গ্যাংএর নির্দেশে অনেক নিরিহ মানুষের উপর হামলা করে হত্যা করেছে এরা।
বিগত দুই বছরে বরিশাল নগরীর কাটপট্টি, ফকির বাড়ী, গীর্জামহল্লা সহ বেলতলার চরআবদানীতে অনেক গুলো দোকানে নগদ অর্থ ও মালামাল সহ প্রায় অর্ধ কোটি টাকার চুরি হয়েছে। এর সাথে এই অটো গ্যাংএর সদস্যরা কোন না কোন ভাবে জড়িত রয়েছে বলে ধারনা করছেন স্থানীয়রা। তবে তারা নিশ্চিত করেছে লঞ্চঘাটে পকেট মারে এই গ্রুপের সদস্যরা। এছাড়া লঞ্চঘাটে প্রতিদিন রাতে ভাসমান শিশুদের দ্বারা গাঁজা বিক্রি করিয়ে থাকেন সাজ্জাদ ও বেল্লাল।
চরআবদানী এলাকার অধিকাংশ মানুষ অভিযোগ করে বলেন, এই গ্রুপের অত্যাচারে অতিষ্ট তারা। তাদের বাসার সামনে মা-বোনদের বিরক্ত করেন এই গ্রুপের সদস্যরা। আর এতে বাঁধা দিলে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বাসা বাড়িতে হামলা চালায় গ্রুপের সকল সদস্যরা।এমন ঘটনা চরআবদানী এলাকায় প্রতিদিনের বিষয়। আর এমন ঘটনার অগনিত মামলা রয়েছে কাউনিয়া থানায়। তার পরেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে এই সন্ত্রাসীরা। বিভিন্ন সময় থানা পুলিশ তাদের আটক করলেও জামিনে বের হয়ে ফের এই অপকর্মের সাথে জড়িয়ে পরে তারা। এই অটো গ্যাংএর সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে চরআবদানীবাসীদের এলাকা ছাড়ার উপক্রম হয়েছে। তাই এলাকাবসীর প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তাদের কাছে একটাই দাবী এই গ্যাং এর গোড়া থেকে উপরে ফেলতে হবে। না হয় তাদের এলাকা ছাড়তে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি বলেন,‘কিছু বখাটে ছেলেরা যারা আমাদের এলাকার কেউ না, তারা আমাদের এলাকায় এসে একের পর এক নানা অপকর্ম করে যাচ্ছেন। আমরা এদের কাজে বাঁধা দিলে আমাদের উপর হামলা করছে দল বেঁধে। প্রশাসন যখন সব অপরাধীদের নির্মুল করছেন সেখানে কিভাবে এই বখাটেরা একের পর এক অপকর্ম করে যাচ্ছে আমরা বুঝতেছি না।’
অপরদিকে এই গ্যাংএর সদস্যদের বসবাসের এলাকা পলাশপুর ৬ নাম্বারের স্থানীয় কিছু ব্যাক্তি বলেন, ‘এদের সকলকে চিনি, তাদের কর্ম সম্পর্কে জানি, তবে এদের বাবার পরিচয় নেই। ওই সেলুনে মুকুলকে প্রশাসন গোপনে আটক করলে অন্য সদস্যরা তাদের হাতে এসে যাবে।’
কিশোর গ্যাং এর ব্যাপারে বিএমপি পুলিশ কমিশনার সাইফুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি বরিশালে যোগদানের পর থেকে অপরাধীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছি। কোন ধরনের অন্যায়কে প্রশ্যয় দেয়া হবে না, সে যেই হোক। আইনানুযায়ী অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’