ও বাবা তোরা আইছো!
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ ‘মোর বুকটা খাইল্যা অইয়া গ্যাছেলে... কত দোয়া করছি, কত কানছি...। ও বাবারা তোরা আইছো!’ বুকের ধন দুই ছেলেকে পেয়ে এমন বিলাপ করছেন মা ফিরোজা বেগম।
বুধবার (২ নভেম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ৭২ দিন পর ভারত থেকে দেশে ফিরে আসেন পাথরঘাটা পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ফারুক শিকদারের ছেলে মো. ফিরোজ শিকদার (৩৩) ও মো. হাসান শিকদার (২৬)।
বুকের ধন দুই ছেলেকে পেয়ে ফিরোজা দম্পতি আনন্দে আত্মহারা। দুই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ফিরোজা বলেন, ‘ওরে বাবা তোরা আবি (আসবি) বুঝতে পারি নাই। আল্লাহর কাছে কত কানছি, আর কইছি। আল্লাহ মোর কান্না হুনছে (শুনছে)। মোর বুকের ধন ফিইর্যা আইছো, আর তোগো ছারমুনা (ছাড়বো না)। তোগোরে সাগরে আর পাডামু না বাবা। ’
পঙ্গু বাবা ফারুক শিকদার বলেন, মোরা আর কিছু চাই না, পোলা দুইডা আইছে। রিকশা চালাইয়া খাইবে, আর সাগরে পাডামু না।
এর আগে গত ১৯ আগস্ট গভীর সমুদ্রে ঝড়ের কবলে উপকূলের পাথরঘাটা, বরগুনা, কলাপাড়া, পিরোজপুর, ভোলা, বাগেরহাটসহ উপকূলের বিভিন্ন স্থানের মাছধরা ট্রলার ডুবে যায়। ডুবে যাওয়া ট্রলারের জেলেরা ভাসতে ভাসতে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জলসীমায় অতিক্রম করার অপরাধে ওই দেশে পুলিশ তাদের আটক করে। দীর্ঘদিন আইনি বেড়াজালে এসব জেলেদের ভারতে থাকতে হয়েছে। তার মধ্যে ইউনুছ গাজী নামে একজন জেলে মৃত্যু হয়। তার বাড়ি পটুয়াখালী জেলায়।
গতকাল মঙ্গলবার (১ নভেম্বর) ৭২ দিন পর বেনাপোল আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট দিয়ে তাদের ফেরত পাঠায় ভারতীয় পুলিশ। বেনাপোল ইমিগ্রেশন পুলিশ জেলেদের আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করে।
বেনাপোল ইমিগ্রেশন পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, গত ১৯ আগস্ট গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার সময় ঝড়ের কবলে পড়ে বরগুনা, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী বাগেরহাটসহ বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি ট্রলার ডুবে যায়। জেলেরা সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে ভারতের জলসীমায় প্রবেশ করে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) তাদের আটক করে। ৭২ দিন আটক থাকার পর আইনি প্রক্রিয়া শেষে তাদের দেশে ফেরত আনা হয়েছে।
বুধবার দুপুর ১২টার দিকে পাথরঘাটার ১৭ জেলে নিজ নিজ বাড়িতে পৌঁছায়। বাড়িতে আসার পরে স্বজনসহ পুরো এলাকায় আনন্দের বন্যা বইছে। ফিরে আসা ১৭ জেলের বাড়ি পাথরঘাটার বিভিন্ন এলাকায়।
ফিরে আসা সহধর দুই ভাই ফিরোজ ও হাসান বলেন, গত ১৯ আগস্ট সাগরে মাছ ধরার সময় ঝড় শুরু হয়। তখন আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ পর ট্রলারে পানি উঠে যায়, ওইভাবেই একদিন-একরাত থাকার পর ট্রলারটি আর রক্ষা করতে পারিনি। ট্রলারটি ডুবে যাওয়ার পর ৪২ ঘণ্টা সাগরে ভাসি। পরে ভারতের একটি মাছ ধরা ট্রলারের জেলেরা আমাদের উদ্ধার করে ভারতের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। পরে আমাদের কে তারা চিকিৎসা শেষে উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার কাকদ্বীপ নামে একটি শেল্টার হোমে রাখে। বাংলাদেশি নাগরিকত্ব যাচাই করে প্রথম ধাপে ৪০ জন বাংলাদেশি জেলেকে দেশে ফেরত পাঠালো ভারত। মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে বেনাপোল দিয়ে দেশে প্রবেশ করে রাতে পিরোজপুর এসে রাতে থাকি।
ট্রলার মালিক মো. ফারুক খান বলেন, আমার অর্ধকোটি টাকার ট্রলার ডুবে গেছে তাতে কষ্ট নেই, ট্রলারে থাকা ১৭ জেলে জীবিত রয়েছে এটিই সব চেয়ে বড় বিষয়।
তিনি আরও বলেন, ভাসতে ভাসতে জেলেরা ভারতে যাওয়ার পর থেকেই তাদের আনতে অনেক চেষ্টা করেছি।
বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, সাগরে ট্রলার ডুবির ঘটনার পর পরই আমি ভারতে একাধিকবার জেলেদের ফিরিয়ে আনতে গিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, ভারতে একটি আশ্রয় কেন্দ্রে ৪০ জন জেলে আটক ছিল। মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে বেনাপোল চেকপোস্টে আসে। সেখানে আইনি প্রক্রিয়া শেষে আমরা জেলেদের আনতে সক্ষম হই। ৪০ জনের মধ্যে বরগুনার ৩০ জনের মধ্যে পাথরঘাটার ১৭ জন।