বরিশালে বিএনপির গণসমাবেশ: পরিবহন ধর্মঘটের নেপথ্যে আ.লীগ নেতারা

দেশ জনপদ ডেস্ক | ১৮:৪৩, নভেম্বর ০১ ২০২২ মিনিট

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ নগরী-সংলগ্ন রায়পাশা-কড়াপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আহমেদ শাহরিয়ার বাবু ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।বরিশাল জেলা টেম্পো মালিক সমিতি ও নগরের রূপাতলী বাস টার্মিনালকেন্দ্রিক বাস শ্রমিকদের সংগঠন জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকও তিনি। একই টার্মিনালকেন্দ্রিক বাস মালিকদের সংগঠন বরিশাল-পটুয়াখালী বাস মালিক সমিতির সম্পাদক কাওছার হোসেন শিপন মহানগর আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক। দু’জনই বরিশাল নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর আস্থাভাজনদের অন্যতম। চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা ও রংপুরের ধারাবাহিকতায় বিএনপির বরিশালের গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে ৪ ও ৫ নভেম্বর বিভাগের ছয় জেলায় পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়েছে। এ ধর্মঘট আহ্বানকারীদের মধ্যে আছেন এই দুই আওয়ামী লীগ নেতা। আবার বাস মালিকরা যে দাবিতে ধর্মঘট ডেকেছেন, তার পাল্টা দাবিতে এই দু’দিন তিন চাকার যানবাহন বন্ধেরও ঘোষণা করেছেন বরিশাল জেলা টেম্পো শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেন লিটন মোল্লা। তিনি নগরঘেঁষা কাশীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ঘটনাক্রমে দেখা যাচ্ছে, বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে দু’দিনের পরিবহন ধর্মঘট আহ্বানকারীদের নেপথ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তাঁরা স্থানীয় বাস মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর নিয়ন্ত্রক। বিভাগের ছয় জেলার বাস মালিকদের নিয়ে গঠিত সমন্বয় পরিষদের নামে দু’দিন ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছে। যদিও ধর্মঘট আহ্বানকারীদের দাবি, পরিবহন ধর্মঘটের সঙ্গে রাজনৈতিক কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁরা নিজ দাবিতে ধর্মঘট ডেকেছেন। জানা গেছে, বরিশালের পরিবহন সেক্টর অদৃশ্যভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। তিনি পরিবহন সেক্টরে বরিশাল বিভাগজুড়ে দুটি সংগঠনের সভাপতি। সংগঠন দুটি হচ্ছে বরিশাল বিভাগীয় আঞ্চলিক সড়ক পরিবহন মালিক ফেডারেশন এবং বরিশাল বিভাগীয় আঞ্চলিক সড়ক পরিবহন মালিক ও শ্রমিক ঐক্য ফেডারেশন। এদিকে, গতকাল অত্যাবশ্যকীয় সেবা খাতে ধর্মঘট ডাকলে বা সমর্থন দিলে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ডের বিধান রেখে আনা অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা আইন, ২০২২-এর চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। খসড়াটি আইনে পরিণত হলে জনজীবন ব্যাহত হয় এমন কোনো ক্ষেত্রে ইচ্ছা করলেই আর ধর্মঘট বা হরতাল ডাকা যাবে না। বরিশাল জেলা বাস মালিক গ্রুপের সভাপতি গোলাম মাশরেক বাবলু জানিয়েছেন, মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহনসহ অনুমোদনহীন যানবাহন চলাচল বন্ধের দাবিতে বরিশাল বিভাগীয় বাস মালিক সমন্বয় পরিষদ দু’দিনের ধর্মঘট আহ্বান করেছে। বিভাগের ছয় জেলায় দু’দিন বাস চলাচল বন্ধ থাকবে। বিএনপির গণসমাবেশের সময় ধর্মঘটের তারিখ নির্ধারণ হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, অন্যান্য জেলা সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করতে তাঁদের কিছুটা সময় লেগেছে। তাঁর বক্তব্য যে সত্য নয়, তার প্রমাণ মিলেছে ভোলা জেলা বাস মালিক সামিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালামের বক্তব্যে। তিনি বলেন, দ্বীপ জেলা ভোলার সঙ্গে বরিশালসহ দেশের কোনো জেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ নেই। জেলা শহরের সঙ্গে উপজেলা শহরের যোগাযোগেই তাঁদের একমাত্র সড়ক পথ। যে কারণে তাঁরা কোনো ধর্মঘটেও নেই। তবে অভ্যন্তরীণ সড়কেও থ্রি-হুইলার চলাচল করায় তাঁরাও ভুক্তভোগী। তাহলে থ্রি-হুইলার চলাচল বন্ধের দাবির ধর্মঘটে কেন যুক্ত হবেন না, জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের এই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, বিষয়টি নিয়ে নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করবেন। একই প্রশ্নে আটকে যান পিরোজপুর জেলা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সরদার শহিদুল ইসলাম। এ জেলাটি খুলনা বিভাগের বাগেরহাট জেলাঘেঁষা।দু’দিনের ধর্মঘটে বরিশালমুখী বাসের সঙ্গে বাগেরহাট-খুলনামুখী বাসও বন্ধ রাখা হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ জন্য তাঁদের বাগেরহাট বাস মালিক সমিতির সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। ঝালকাঠি জেলা বাস মালিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক ও ভৈরবপাশা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. নাসির উদ্দিন জানান, তাঁদের সমিতিভুক্ত সব রুটের বাস দু’দিন বন্ধ রাখবেন। তিন জেলার সংগঠকই জানিয়েছেন, ধর্মঘটের বিষয়ে তাঁরা আগে জানতেন না। ধর্মঘট চূড়ান্ত হওয়ার পর সমন্বয় পরিষদ চিঠি দিয়ে তাঁদের অবহিত করেছে। অন্যদিকে, টেম্পো শ্রমিক ইউনিয়ন পাঁচ দফা দাবিতে ৪ ও ৫ নভেম্বর জেলায় তিন চাকার চলাচল বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে রোববার রাত ৯টায়। তাঁদের প্রধান দাবি, মহাসড়কে বাস মালিক ও চালকদের তিন চাকার যানবাহন চলাচলে বাধা ও চালকের হয়রানি বন্ধ। তিন চাকার যান চলাচল বন্ধের দাবিতে বিএনপির গণসমাবেশের সময় দু’দিনের বাস ধর্মঘটের মধ্যে একই সময়ে টেম্পো শ্রমিক ইউনিয়নের পাল্টা ধর্মঘট পুরো বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু বরিশাল নয়, বিভাগের অপর পাঁচ জেলায়ও বাস মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের শীর্ষ পদগুলো স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের দখলে।সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর শ্বশুর আনোয়ার হোসেন সিকদার জেলা ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি। মেয়রের প্রধান আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত মহানগর আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক নিরব হোসেন টুটুল বিভাগীয় ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি। বরিশাল কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালকেন্দ্রিক (নথুল্লাবাদ) সংগঠন বরিশাল বাস মালিক গ্রুপের সভাপতি গোলাম মাশরেক বাবলু ও সাধারণ সম্পাদক কিশোর কুমার দে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে নেই। তবে টার্মিনাল সূত্রে জানা গেছে, এই টার্মিনালের মূল নিয়ন্ত্রক হলেন মালিক সমিতির সদস্য মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক রইছ আহমেদ মান্না। নগরের রূপাতলীতে আরেকটি বাস টার্মিনালকেন্দ্রিক বরিশাল-পটুয়াখালী বাস মালিক সমিতির সভাপতি মোমিন উদ্দিন কালু পদহীন আওয়ামী লীগ নেতা এবং সাধারণ সম্পাদক কাওছার হোসেন শিপন মহানগর আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক। ঝালকাঠি জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সরদার শাহ আলম বাস মালিক সমিতিরও সভাপতি। সাধারণ সম্পাদক মিলন মাহমুদ বাচ্চু রাজাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি। পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক মো. রিয়াজ উদ্দিন মৃধা জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক আরিফুজ্জামান রণি জেলা যুবলীগের সহসভাপতি। ভোলা জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আখতার হোসেন লালমোহন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগ ঘরনার হলেও তাঁর দলীয় পদ নেই। বরগুনা জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা কিসলু দলীয় পদে নেই। সাধারণ সম্পাদক সগীর হোসেন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। পিরোজপুর জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি জসিম উদ্দীন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য ও সাধারণ সম্পাদক সরদার শহীদুল ইসলাম স্থানীয় আওয়ামী লীগের পদহীন নেতা।