আত্মহত্যায় এগিয়ে নারী শিক্ষার্থীরা

দেশ জনপদ ডেস্ক | ১৮:২৪, সেপ্টেম্বর ১০ ২০২২ মিনিট

রিপোর্ট দেশজনপদ ॥ এ বছর জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮ মাসে ৩৬৪ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও আত্মহননের সংখ্যা বাড়ছে। রাজধানী ঢাকায় এর হার সবচেয়ে বেশি। প্রেমঘটিত বিষয়, পারিবারিক চাপ, পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রধান কারণ। বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। শুক্রবার (৯ সেপ্টেম্বর) ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটি জানায়, নারী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনা এ বছরও বেড়েছে। মোট আত্মহননকারীদের ৬০.৭১ শতাংশ নারী। সংখ্যায় যা ২২১ জন। অন্যদিকে পুরুষ ১৪৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যায় মৃত্যু বরণ করেছে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, কম বয়সী স্কুলগামী থেকে শুরু করে তরুণ প্রজন্মদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি।স্কুলগামী আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও ৬০ শতাংশেরও বেশি। এই হার এতো উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার পিছনে কোন কারণগুলো আছে তা খুঁজে বের করে প্রদক্ষেপ নেওয়া সময়ের দাবি। আত্মহত্যা প্রতিরোধে সমন্বিত কাজ করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি। গবেষণা বিশ্লেষণে দেখা যায়, আট মাসে মোট আত্মহননকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫০ জন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, যাদের মধ্যে পুরুষ শিক্ষার্থী ৬০ শতাংশ এবং নারী শিক্ষার্থী ৪০ শতাংশ। কলেজপড়ুয়াদের মধ্যে ৭৬ জন এই পথ বেছে নেয় যাদের মাঝে ৪৬.০৫ শতাংশ পুরুষ এবং ৫৩.৯৫ শতাংশ নারী। সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ১৯৪ জন স্কুলগামী শিক্ষার্থী বিগত আট মাসে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩২.৯৯ শতাংশ পুরুষ এবং ৬৭.০১ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী। এমনকি মাদ্রাসায় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও আত্মহত্যার মাধ্যমে জীবনাবসানের পথ বেছে নিয়েছে যা সংখ্যায় ৪৪ জন। তাদের মধ্যে ৩৯.২৯ শতাংশ পুরুষ এবং ৬০.৭১ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী আছে। আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাকে আত্মহত্যার অন্যতম বড় কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, আমরা দেখেছি শিক্ষার্থীরা পরিবার থেকে কোনো কিছু না পেয়ে অভিমান করেও আত্মহত্যা করেছেন। মোটরবাইক, মোবাইল চেয়ে না পাওয়ার কারণে অনেকেই আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। প্রত্যাশা পূরণ না হলে কিভাবে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, সে বিষয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের অনেক বড় ধরণের অভাব দেখা যাচ্ছে। আত্মহত্যায় স্কুলগামীরা এগিয়ে শিক্ষাস্তর বিবেচনায়, বিদ্যালয়গামী অর্থাৎ প্রাইমারি থেকে মাধ্যমিক পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী আত্মহত্যা করেন ৫৩.৩০ শতাংশ। আত্মহত্যার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা যা ২০.৮৮ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থী রয়েছে ১৩.৭৪ শতাংশ। আত্মহননকারীদের মধ্যে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী রয়েছেন শতকরা ১২.০৯ শতাংশ। টিনেজারদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেড়ে যাওয়া অশনি সংকেত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বয়সভিত্তিক আত্মহত্যার হার গবেষণায় ১৩ থেকে ২০ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে যা ৭৮.৬ শতাংশ। বয়সের সীমারেখায় যারা ২১ থেকে ২৬ বছর বয়সী, তাদের মধ্যে ১৩.৪৬ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নেন। জরিপ থেকে আরও জানা যায়, ১৩ বছরের নিচে যাদের বয়স, তারাও এই পথ থেকে পিছপা হয়নি। ৬ থেকে ১২ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭.৯৭ শতাংশ অর্থাৎ ২৯ জন আত্মহত্যা করেন। তবে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেন ১৪ - ১৬ বছর বয়সীরা, যার সংখ্যা ১৬০ জন। এছাড়াও সর্বনিম্ন সাত বছরের একটি শিশুও আত্মহত্যা করেন বলে তথ্যে উঠে এসেছে। বিভাগ অনুযায়ী আত্মহত্যা আত্মহত্যাকারীদের অবস্থান বিবেচনায় সবার শীর্ষে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। আত্মহননকারীদের মধ্যে ঢাকায় গত ৮ মাসে শতকরা ২৫.২৭ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। চট্টগ্রাম বিভাগে ১৬.৪৮ শতাংশ এবং খুলনা বিভাগে ১৪.০১ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। দেশের অপরপ্রান্তে রংপুর বিভাগে আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থী রয়েছেন ৮.৭৮ শতাংশ। এছাড়া বরিশাল বিভাগে ৯.৬২ শতাংশ, ময়মনসিংহ বিভাগে ৭.৪২ শতাংশ এবং রাজশাহী বিভাগে ১৪.০১ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তবে সিলেট বিভাগে তুলনামূলকভাবে কম সংখ্যক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন যা শতকরা ৪ শতাংশ। প্রেমঘটিত কারণ সবচেয়ে বেশি দায়ী আত্মহত্যার ঘটনা অনুসন্ধানে জানা গেছে প্রেম ঘটিত কারণে ৪ জনের একজন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এছাড়াও অভিমান, সেশনজট, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, পড়াশোনার চাপ, পরিবার থেকে কিছু চেয়ে না পাওয়া, পারিবারিক কলহ, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি, চুরি বা মিথ্যা অপবাদ, বিষণ্নতা, বন্ধুর মৃত্যু, আর্থিক সমস্যার মত বিষয়ও রয়েছে। গেল আট মাসে ২৫.২৭ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রেমঘটিত কারণে নিজের জীবন বিকিয়ে দেন। অভিমান করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন ২৪.৭৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। পারিবারিক কলহের কারণে ৬.৫৯ শতাংশ আত্মহত্যা করেছেন। অন্যদিকে, ধর্ষণ কিংবা যৌন হয়রানির কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় ৪.৬৭ শতাংশ। পড়াশোনার চাপে ০.৮২ শতাংশ, সেশনজটের কারণে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে ০.৮২ শতাংশ এবং পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় ১.৯২ শতাংশ আত্মহননের দিকে এগিয়ে যান। আত্মহত্যার পিছনে দায়ী সাইবার ক্রাইমও অনলাইন নির্ভরশীলতার যুগে প্রতিদিন জীবনের একটা বড় সময় কেটে যায় ইন্টারনেট তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও মোবাইলে ধারণের মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন ৪ জন শিক্ষার্থী। এই ৮ মাসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আত্মহত্যা করেন ৮ জন এবং ভিডিও কলে এসে আত্মহত্যা করেন ২ জন। আর সেলফি ক্যামেরা নিজের দিকে তাক করে আত্মহত্যা করেন ০.২৭ শতাংশ প্রেমিক যুগল। এছাড়া মৃত্যুর পূর্বে চিরকুট বা সুইসাইড নোট লিখে ৮ জন আত্মহত্যা করেছেন। পত্রিকা থেকে সংগৃহীত আত্মহত্যার ঘটনার সংখ্যা অনুযায়ী এই গবেষণা করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটি আত্মহত্যা মোকাবেলায় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন, সব ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দ্রুত ও সহজলভ্য করতে একটি টোল ফ্রি জাতীয় হট লাইন নম্বর চালুসহ ১০ প্রস্তাব তুলে ধরে। আজ আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস ১০ সেপ্টেম্বর আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। বিশ্বের অনেক দেশে ২০০৩ সাল থেকে দিবসটি পালন করা হয়। আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংস্থার সাথে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বৈশ্বিক মানসিক স্বাস্থ্য ফেডারেশন একসাথে কাজ করে। দুই সংস্থার প্রতিবেদন অনযায়ী বিশ্বের নিম্ন আয়ের কোনো দেশেই আত্মহত্যা প্রতিরোধে কোন কৌশল বা কর্মপন্থা নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে আত্মহত্যা প্রতিরোধে প্রধান বাধা হলো সামাজিক সচেতনতার অভাব ও আত্মহত্যার সচেতনতায় উন্মুক্ত আলোচনার সংকট।