১৮ ফুট প্রশস্ত সড়ক দিয়ে ৩ বন্দর সংযোগের স্বপ্ন!

দেশ জনপদ ডেস্ক | ১৯:৪৪, সেপ্টেম্বর ০৮ ২০২২ মিনিট

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ * মিলছে না বঙ্গমাতা সেতুর পূর্ণ সুফল * বেড়েছে যানজট, পথে বড় ঝুঁকি ছয় বেইলি  * জেলা সড়ক জাতীয় সড়কে উন্নয়নের প্রস্তাব পড়ে আছে পরিকল্পনা কমিশনে  প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, সেতু নির্মিত হলে সড়কপথে সহজেই যোগাযোগ স্থাপিত হবে সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম, পায়রা ও মোংলার মধ্যে। উপকূলীয় তিন বিভাগ চট্টগ্রাম, বরিশাল ও খুলনার মধ্যেও প্রতিষ্ঠিত হবে সহজ সড়ক যোগাযোগ। এর ৬ বছর পর ৪ সেপ্টেম্বর দুয়ার খুলেছে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেসা ৮ম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর। পিরোজপুরের কচা নদীর উপর স্থাপিত এ সেতুর কারণে বরিশাল থেকে এখন সরাসরি সড়কপথে যাওয়া যাচ্ছে খুলনায়। তবে যে লক্ষ্য নিয়ে সেতু স্থাপনের পরিকল্পনা-সেটি এখনো তিমিরেই রয়ে গেছে। কারণ, অপ্রশস্ত দুটি আঞ্চলিক মহাসড়ক আর সরু জেলা সংযোগ সড়ক। এসব সড়কের উন্নয়ন না হওয়ায় নয়শ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সেতুর সুফল পাচ্ছেন না ব্যবহারকারীরা। বরং বরিশাল থেকে পিরোজপুরের নৈকাঠী পর্যন্ত ৪৩ কিলোমিটার সড়কে থাকা ৩০ থেকে ৩৫ বছরের পুরোনো কয়েকটি বেইলি সেতু যানবাহন চলাচল আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। মৈত্রী সেতু চালু হওয়ার পর এ সড়কে এরইমধ্যে বেড়েছে যানবাহনের চাপ। সেইসঙ্গে বেড়েছে যানজট। চালকরা জানিয়েছেন, যে হারে চাপ বাড়ছে তাতে কিছুদিন পর এই সড়কে চলাচল কঠিন হয়ে পড়বে। এমনটি হতে পারে-তা আঁচ করতে পেরে আগেভাগেই উদ্যোগ নিয়েছিল সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়। বরিশাল থেকে ঝালকাঠী-পিরোজপুর-বাগেরহাট হয়ে খুলনা পর্যন্ত সড়কটি জাতীয় মহাসড়কে উন্নীত করার প্রস্তাবও দিয়েছিল। কিন্তু সেই প্রস্তাব পড়ে আছে পরিকল্পনা কমিশনে। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্টর বাংলাদেশ সফরকালে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী পিরোজপুরের বেকুটিয়ায় কচা নদীর উপর সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। প্রি স্ট্রেসড কংক্রিট বক্স গার্ডার পদ্ধতির এ সেতুর নির্মাণ শুরু হয় ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর। ৮৯৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর রোববার তা উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। লক্ষ্য পূরণে সেতুর নির্মাণকাজ শুরুর সঙ্গে নিজেদের কাজও শুরু করে সড়ক বিভাগ। চট্টগ্রাম থেকে লক্ষ্মীপুর-ভোলা হয়ে বরিশাল পর্যন্ত মহাসড়কটি বহু আগেই জাতীয় মহাসড়কে উন্নীত হয়েছে। মৈত্রী সেতু হয়ে এই যাতায়াত যাতে আরও সহজ হয় সেজন্য প্রথমেই বরিশাল-পিরোজপুর-বাগেরহাট-খুলনা আঞ্চলিক মহাসড়কটি জাতীয় মহাসড়কে উন্নীত করার প্রক্রিয়া শুরু করে বিভাগটি। সে সময় বরিশালের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর দায়িত্বে ছিলেন বর্তমানে সিলেট সড়ক বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ফজলে রব্বে। তিনি  বলেন, ‘আঞ্চলিক মহাসড়কের প্রস্থ হয় ২৪ ফুট। জেলা সংযোগ সড়কের ক্ষেত্রে ১৮ ফুটের বেশি হয় না। তবে জাতীয় মহাসড়কের ক্ষেত্রে প্রস্থের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কচা নদীর উপর সেতু হলে বরিশাল-খুলনা-চট্টগ্রাম সড়ক যোগাযোগ সহজ হওয়ার পাশাপাশি বিদ্যমান সড়কে যানবাহনের চাপ বাড়বে ভেবে বরিশাল থেকে পিরোজপুর-বাগেরহাট-খুলনা সড়কটি জাতীয় মহাসড়কে উন্নীতকরণের কাজ শুরু করি আমরা। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রস্তাবও পাঠানো হয়। তারপর আমি বদলি হয়ে আসি। তাই পরে কী হয়েছে বলতে পারব না।’ সড়ক বিভাগের বরিশাল দপ্তরের একাধিক সূত্র জানায়, বরিশাল থেকে প্রস্তাব ঢাকায় যাওয়ার পর তা অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশন থেকে এখনো সেই অনুমোদন আসেনি। ফলে মৈত্রী সেতু উদ্বোধনের পর যান চলাচল বৃদ্ধি পেয়ে এ সড়কে জটিলতা কয়েকগুণ বেড়েছে। বরিশাল থেকে ঝালকাঠী জেলার রাজাপুর পর্যন্ত ৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি আঞ্চলিক মহাসড়কের অন্তর্ভুক্ত। এটি ২৪ ফুট চওড়া। রাজাপুর থেকে মৈত্রী সেতু পর্যন্ত যে সড়ক রয়েছে সেটি আবার জেলা সড়কের শ্রেণিভুক্ত। এটির প্রস্থ মাত্র ১৮ ফুট। মৈত্রী সেতুর পশ্চিম প্রান্ত গিয়ে মিলেছে পিরোজপুর জেলা শহরে। এখানে পশ্চিম প্রান্ত থেকে পিরোজপুর শহর হয়ে বলেশ্বর সেতু পর্যন্ত যে সাড়ে ৪ কিলোমিটার সড়ক সেটিও জেলা সংযোগ সড়কের শ্রেণিভুক্ত এবং প্রস্থে ১৮ ফুট। মৈত্রী সেতু নির্মাণের প্রকল্প প্রস্তাব তৈরির সময় এ সাড়ে ৪ কিলোমিটার পথ জেলা শহর দিয়ে না নিয়ে বাইপাস করার একটি প্রস্তাব ছিল। বাইপাস নির্মাণের অত্যাবশকীয় উল্লেখ করে এর দুটি এলাইনমেন্টও নির্ধারণ করে দিয়েছিল পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা অনুমোদন পায়নি। ফলে সেতু পার হওয়া যানবাহন জেলা শহরের মধ্য দিয়েই যাচ্ছে। আগের তুলনায় যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় শহরের এই পথটুকু পাড়ি দিতে চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে চালক ও যাত্রীদের। অথচ সাড়ে ৪ কিলোমিটার পথ শহরের বাইরে দিয়ে নিলে এ সমস্যা হতো না। এখানেই শেষ নয়, ঝালকাঠীর রাজাপুর থেকে মৈত্রী সেতু পর্যন্ত থাকা ১২ কিলোমিটার সরু সড়কে দুটি বাস কিংবা ট্রাক মুখোমুখি অতিক্রম যেমন কষ্টসাধ্য তেমনি যানবাহনের চাপ বৃদ্ধি পাওয়ার পর প্রায়ই লেগে থাকছে যানজট। এ সড়কে থাকা ৫টি বেইলি সেতু নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা। বহু বছরের পুরোনো জরাজীর্ণ এসব সেতু হয়ে দাঁড়িয়েছে বড় ধরনের হুমকি। একই অবস্থা ঝালকাঠী জেলা শহরের উপকণ্ঠে বাসণ্ডা নদীর উপর থাকা বেইলি সেতুরও। ৪শ ফুট দৈর্ঘ্যরে এ সেতুটির বয়স পেরিয়ে গেছে ৩০ বছর। ফি বছর কোটি টাকা ব্যয়ে মেরামত করে সচল রাখা হয়েছে সেতুটি। তবে অতিরিক্ত গাড়ির চাপ যে কোনো সময় জন্ম দিতে পারে বড় দুর্ঘটনার। বরিশাল নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘২০১৬ থেকে ২০২২-এই ৬ বছরেও মৈত্রী সেতুকেন্দ্রিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোকে প্রয়োজনীয় উন্নয়নে আনতে না পারাটা সত্যিই দুঃখজনক। আজ মৈত্রী সেতু চালু হল অথচ তার সুফল পাচ্ছি না আমরা। অলোচ্য মহাসড়কটি যদি আরও আগে জাতীয় মহাসড়কের মর্যাদা পেত তাহলে এই সমস্যা থাকত না।’ সড়ক ও সেতু বিভাগ বরিশালের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী একেএম আজাদ রহমান বলেন, ‘চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে পরিকল্পনা কমিশনে দেওয়া চিঠিতে বরিশাল-পিরোজপুর-বাগেরহাট-খুলনা সড়ক জাতীয় মহাসড়কে উন্নীত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। তাছাড়া বাসন্ডা নদীর উপর নতুন সেতু নির্মাণের প্রাথমিক সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন করেছি আমরা। এটি বর্তমানে সড়ক ও সেতু বিভাগের কেন্দ্রীয় সেতু প্রকল্পে অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা চলছে। আশা করি খুব শিগগিরই বিরাজমান সমস্যাগুলোর সমাধান হয়ে যাবে।’