দূষণে প্রাণ হারাচ্ছে কীর্তনখোলা, পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কা
নিজস্ব প্রতিবেদক॥ কীর্তনখোলা নদীবিধৌত বরিশাল নগরীতে ইতোমধ্যে ২২টি খাল দখল-দূষণে মরে গেছে। যে কয়েকটি টিকে আছে, তাও নর্দমা হিসেবে ব্যবহার করছে স্থানীয়রা। নগরবাসী এসব বন্ধে দফায় দফায় আন্দোলন-সংগ্রাম চালালেও কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। এতে নদী মরে গিয়ে পরিবেশ পড়ছে হুমকির মুখে।
শুধু নগরীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত খালগুলো নয়, এবার পরিবেশ বিপর্যয়ের হুমকিতে খোদ কীর্তনখোলা নদী। বরিশাল নগরীর পাশ ঘেঁষে বহমান এ নদী। বরিশালে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এ নদীর ভূমিকা ব্যাপক। কিন্তু এর তলদেশে পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যের আস্তরণ পড়ার কারণে শঙ্কা দেখা দিয়েছে নদীর ভবিষ্যৎ নিয়ে।
নদী খননকারীরা বলছেন, নদীর তলদেশের বেশ কয়েকটি স্থানে পলিব্যাগের আস্তরণ পড়ে যাচ্ছে। মূলত নগরীর ভেতরকার খাল থেকে এসব পলিথিন ও ময়লা-আবর্জনা কীর্তনখোলায় নির্গত হয়। এ ছাড়া বড় একটি অংশ নৌযান কর্তৃপক্ষ ও যাত্রীদের কারণে হচ্ছে। এভাব চলতে থাকলে বুড়িগঙ্গার মতো করুণ পরিণতি হতে পারে শান্ত-স্নিগ্ধ রূপবতী কীর্তনখোলার।
পরিবেশ আন্দোলনকর্মীদের মতে, পুরো দক্ষিণাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ঠিক রাখতে দূষণের হাত থেকে কীর্তনখোলা নদীটি বাঁচাতে হবে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের স্পষ্টভাবে নির্দেশনা থাকার পরও নদীকে দূষিত করে যাচ্ছে, যা আতঙ্কের বিষয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কীর্তনখোলার সঙ্গে সংযুক্ত জেল খাল, ভাটার খাল, ভিআইপি কলোনির ড্রেন থেকে সরাসরি নগরীর বর্জ্য গিয়ে পড়ছে নদীতে। তা ছাড়া নদীবন্দর থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করায় তারাও ময়লা-আবর্জনা নদীতে ফেলে দিচ্ছে। নগরীর এসব ময়লার অধিকাংশই পলিথিন। যেগুলো নদীতে পতিত হওয়ার পরে দু-এক দিন ভেসে থেকে তলিয়ে গিয়ে নদীর তলদেশে জমা হয়।
এমভি পারাবত-৯ লঞ্চের সুপারভাইজার বাবুল হোসেন বলেন, অনেক লঞ্চের স্টাফ ও যাত্রীরা পলিথিন-ময়লা-আবর্জনা ফ্যান্টারে জমা করে সকালে ঝাডু দিয়ে নদীতে ফেলে দেয়। এটা কারোরই করা উচিত নয়। এতে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। নদী মরে যাচ্ছে। শুধু আইন প্রয়োগ করলেই সমাধান হবে না। এর জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে।
এমভি অ্যাডভেঞ্চার-৯ লঞ্চের কেবিন কেরানি সাব্বির আহম্মেদ বলেন, অসচেতন অনেক মানুষের কারণে দূষণের শিকার হচ্ছে কীর্তনখোলা। তারা পলিথিন, ময়লা, আবর্জনা নদীতে ফেলে দেয়। এতে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।
বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজার বিভাগে কর্মরত সুজন বলেন, বরিশাল নদীবন্দর ও আশপাশের এলাকায় ড্রেজিং করতে গিয়ে আমরা মারাত্মক ঝামেলার মধ্যে থাকি। এক ঘণ্টা ড্রেজিং করলে ড্রেজারের ব্লেডে যে পলিথিন আটকে যায়, তা ছাড়াতে কমপক্ষে ২০ মিনিট সময় লাগে। এসব পলিথিন মূলত লঞ্চের যাত্রী ও লঞ্চ স্টাফরা ফেলে।
নদীবন্দরের পন্টুন লস্কর দেলোয়ার হোসেন বলেন, অসচেতন যাত্রী ও লঞ্চ কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময় ময়লা-আবর্জনা সরাসরি নদীতে ফেলে দিচ্ছে। এতে কীর্তনখোলার পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতি হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বরিশালের সমন্বয়কারী রফিকুল আলম বলেন, ১৯৫০ সালের নদী ও জলাধার সুরক্ষা আইনে স্পষ্ট উল্লেখ আছে কোনোভাবেই নদী দূষণ করা যাবে না। নদী দূষিত হলে পরিবেশের ভারসাম্য, জীববৈচিত্র্য, নদীর সঙ্গে যুক্ত ও নির্ভরশীল জীবিকা নষ্ট হয়ে যায়। আবার দেশের সর্বোচ্চ আদালত স্পষ্টভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন, নদীকে কোনোভাবেই দূষণ করা যাবে না। সেটি শিল্পকারখানা বা মানুষের ব্যবহারের কারণে হোক।
তিনি আরও বলেন, কীর্তনখোলা নদী রক্ষায় আমরা লঞ্চে লঞ্চে প্রচারণা চালিয়েছি। লঞ্চ কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেছি যেন তারা ময়লা-আবর্জনা, পলিথিন নদীতে না ফেলে। নির্ধারিত ডাস্টবিন ব্যবহারের জন্য আহ্বান করেছি যেন সকালে সিটি করপোরেশন গিয়ে ময়লা নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু এসব মানছে না লঞ্চ কর্তৃপক্ষ ও যাত্রীরা। তারা সব ধরনের বর্জ্য নদীতে ছুড়ে বা ঝাডু দিয়ে ফেলছে। এতে কীর্তনখোলার তলদেশে পলিথিনের আস্তর পড়ছে।
নদীদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তর কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই, এমনটা জানিয়ে তিনি বলেন, এমনকি বরিশালের জেলা প্রশাসনকে অনুরোধ করেছিলাম যেন মাসে একটি করে হলেও ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করা হয়। কিন্তু তা-ও হচ্ছে না।
পরিবেশ অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় পরিচালক আবদুল হালিম বলেন, কীর্তনখোলা নদীটি দূষিত হচ্ছে, বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। বিশেষ করে বরিশাল নদীবন্দর এলাকা। এ জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি বিভাগীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, লঞ্চ কর্তৃপক্ষ শিগগিরই আমরা সেমিনার করে এই বন্দরকে পলিথিন-মুক্ত ঘোষণা করব। নদীটির ভারসাম্য বজায় রাখতে যা দরকার, সবই করবে পরিবেশ অধিদপ্তর।
বরিশাল নদীবন্দর কর্মকর্তা ও বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নদীতে পলিথিন ফেলা বন্ধ করতে আমরা লঞ্চ কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দিয়েছি। এ ছাড়া নৌবন্দরের জমিতে ডাস্টবিন তৈরি করে দিয়েছি। এরপরও যদি কেউ আইন অমান্য করে নদীতে ময়লা ফেলে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ ফারুক আহম্মদ বলেন, বরিশাল নগরীর মধ্য থেকে প্রবাহিত ৪৬টি খাল পুনরুদ্ধার এবং খননে ২৬ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পটি পাস হলেই খালগুলো উদ্ধার করা হবে। তখন নগরীর পরিবেশ ফিরে আসবে। দূষণের হাত থেকে নদী রক্ষা পাবে।