মনির হত্যা নেপথ্যে কি মীরগঞ্জ খেয়াঘাটের ইজারা?

দেশ জনপদ ডেস্ক | ১৯:৪৭, জুন ০১ ২০২২ মিনিট

বিধান সরকার ॥ গেল ২৩ মে রাতের কোন এক সময় নির্মমভাবে জবাই করে হত্যা করা হয় সরল প্রকৃতির দুই শিশু সন্তানের জনক মনির হাওলাদারকে (৩৫)। মুলাদী ফেরিঘাটের দক্ষিণ পাশের্  চরকমিশনার গ্রামে ঘেরের কাছাকাছি ২৪ মে সকালে তার মৃতদেহ মেলে। ওদিনই নির্দয় হত্যার শিকার মনিরের ছোট ভাই পারভেজ হাওলাদার বাদী হয়ে ১০ জনকে নামধারী আর ৭/৮ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামী করে হত্যা মামলা করেন মুলাদী থানায়। মামলার দিন পেড়–নো রাতে ৯ নম্বর আসামী জামাল মৃধাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আদালতে তার রিমান্ড চেয়েছেন বলে জানালেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আঃ কাউয়ূম। তবে মামলার তদন্তের স্বার্থে অগ্রগতির আর কোন তথ্য জানাতে চাচ্ছে না পুলিশ। গেল ২৭ মে সরেজমিন ঘুরে এসে অজাতশত্র“ মনিরকে হত্যার নেপথ্যে কি কারণ থাকতে পারে তা উঠে এসেছে এলাকাবাসী ও স্বজনদের জবানীতে। মনিরের ছোট বোন নুপুর আক্তার বলেন, এক সময় তার ভাই ও ভাবি হাওয়া বেগম গাজীপুরের একটি বায়িং হাউসে কাজ করতেন। তাদের ঘরে দুই সন্তান হাফিজুল ও মরিয়ম, যাদের বয়স বর্তমানে যথাক্রমে ১২ এবং ৬ বছর। চার বছর আগে মানসিক বৈকল্য দেখা দিলে ভাবি হাওয়া বেগমের অনুরোধে চিকিৎসা করাতে মনির হোসেন গ্রামের বাড়ি কাজীরচর ইউনিয়নের চরকমিশনার গ্রামে চলে আসেন। এরপর একই গ্রামের কামাল সর্দারের গরুর খামারে কাজ নেন। সেখানে ৩ বছর কাজ করার পর নিয়মিত বেতনের টাকা পরিশোধ করেনি। সেখানে মজুরীর লাখ টাকার ন্যায় পাওনা বকেয়া বলে নুপুরের দাবী। এরপর মনির হোসেন একই গ্রামের বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বর শামীম খানের গোয়ালে কাজ নেন এবং ১ বছর কাজ করেন। সেখানে পাওনা টাকা সম্প্রতি পরিশোধ করেন শামীম খান। মাস তিনেক হলো মুলাদী-হিজলা বাসের টিকেট কাউন্টারম্যান রাজীব হাওলাদারের সহযোগি হিসেবে কাজ পায়। এই টিকেট কাউন্টারে মনিরের ছোট ভাই পারভেজ আগে থেকেই কাজ করতেন। আর পারভেজই বড় ভাই নিহত মনিরকে রাজীবের সাথে জুড়ে দেন। শর্ত ছিল খাওয়া আর রাতে রাজীবের বাড়িতেই মনিরের থাকা। সেই সুবাদে ২৩ মে মনির হোসেনকে হত্যার রাতে রাজীবের অধীনেই ছিল তার ভাই এমনটাই দাবী বোন নুপুর আক্তারের। এজন্য ভাই হত্যার সন্দেহের তীর এই রাজীব হাওলাদারের দিকে। আর বুধবার দুপুর থেকেই রাজীব হাওলাদার গাঢাকা দেয় বলে এই সন্দেহ আরো তীব্র হয়। পাশাপশি কাজের বকেয়া পাওনা টাকা চেয়ে হুমকী পাওয়া কামল সর্দারের নাম হত্যা মামলার তালিকার ১ নম্বরে। মনির হাওলাদারকে নৃশংসভাবে হত্যা করার ২৩মে রাতে মুলাদী ফেরীঘাটে সাউন্ডবক্স বাজিয়ে ট্রলার ও স্পীডবোট চালকরা মিলে পিকনিকের আয়োজন করেছিল। রাত আড়াইটা অবধি সাউন্ডবক্স বাজিয়ে উল্লাস করেছিল চালকরা। এই পিকনিকের আয়োজনের নেপথ্যে মনির হাওলাদার হত্যার বিষয় জড়িয়ে থাকতে পারে স্বজনদের এমন দাবীর বিষয়ে ট্রলার চালক ইমরানকে জিজ্ঞাসা করলে সরাসরি না বলেন। আর মনির এই পিকনিকে এসেছিল কিনা তা জানতে চাইলে বলেন, তাদের অয়োজিত পিকনিকে মনির ছিল না। একসময় মনিরকে চিনেন না জানালেও কিছুটা বিরতি নিয়ে বলেন, মনিরকে দেখলে চিনি। তবে শান্ত স্বভাবের মানির হাওলাদারের বিচরণ বা কাজের ক্ষেত্রই ছিল মুলাদী ফেরীঘাট। এখানের দোকানীরা এবং অটো আর ভ্যান চালকরা গোবেচারা মনিরকে অমানবিকভাবে হত্যা করার নেপথ্যে প্রতিহিংসাই কাজ করছে বলে মনে করেন। এসময় তারা খুনের ঘটনায় প্রকৃত দোষীদের বিচারের দাবীও তোলেন। হত্যার ঘটনায় আরেক কারণ তুলে ধরেন নিহত মনির হাওলাদের চাচাতো ভাই কামাল হাওলাদার এবং মামাতো ভাই আঃ জব্বার। তাদের দাবী মীরগঞ্জ ফেরিঘাটের ইজারর বলি মনির। তারা বলেন, দীর্ঘ বছর ধরে এই ঘাটের ইজারা নিয়ে একদিকে কামাল সর্দার ও শামীম খাঁ গ্র“প অপরদিকে সুমন রাঢ়ী ও আব্বাস গ্র“পের দ্বন্দ্ব চলে আসছে। গেল ৩ বছর একটানা এই ঘাট চালায় সুমন রাঢ়ী ও আব্বাস গ্র“পের লোকজন। ওসময় কামাল সর্দারের ট্রলারগুলো বসেছিল। এবার পহেলা বৈশাখ থেকে জেলা পরিষদের এই খেয়াঘাটের ডাক পায় কামাল সর্দার গ্র“প। তারা এসেও প্রতিপক্ষের ট্রলার চালানো বন্ধ করে দেয়। এই দ্বন্দ্ব থেকে এক পক্ষ অপর পক্ষকে ফাঁসাতে নিরীহ মনির হাওলাদারকে জবাই করে হত্যা করেছে। তাদের দাবী ইজারাদার দুই গ্র“পের দ্বন্দ্বে একাধিক মামলা চলমান। তাই এই বিষয় ধরে তদন্ত করলে তাদের ভাই হত্যার রহস্য বের হয়ে আসবে। এক সময় খেয়াঘাটের ইজারার সাথে জড়িত এক ব্যক্তি বলেন, জেলা পরিষদ থেকে লোক পারাপারে জনপ্রতি ৬ টাকা আর মোটরসাইকেল পাড়াপাড়ে ১০ টাকা নেয়ার নিয়ম সম্বলিত তালিকা বোর্ড টানানো হয়েছিল। কিন্তু ওই বোর্ড খুলে ফেলে ইজারাদারের লোকেরা জনপ্রতি ১০ টাকা আর মোটরসাইকেল পারাপারে ৩০ টাকা নিয়ে থাকে। এখানে গড়ে প্রতিদিন ৬ হাজার যাত্রী এবং ৫শ’ মোটরসাইকেল পারাপার হয়ে থাকে। এই বাড়তি লোভের কারণে টানা ৩ বছর ধরে যারা অবৈধভাবে টাকা কামাই করেছে, মনির হত্যার নেপথ্যে তাদের উপস্থিতি আছে কিনা এ বিষয়ও নজরে আনতে হবে। উল্লেখ্য, গত ২৩ মে সোমবার রাতে মুলাদী উপজেলার কাজিরচর ইউনিয়নের চরকমিশনার গ্রামে মনির হাওলাদার (৩২) নামের এক যুবককে চোখ উৎপাটনের পর গলা কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। মঙ্গলবার সকালে গ্রামের একটি পুকুরের পাশ থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়।