১৩ বছরের শিশু মেয়েটি ছেলে সন্তানের মা!
রিপোর্ট দেশজনপদ॥ সবে পঞ্চম শ্রেণি পাস করেছে মেয়েটি। বাবা টাকা নিয়ে এলে ভর্তি হবে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। এখন স্কুল বন্ধ। তাইতো খেলা করেই দিন কাটে তার। সন্তান জন্ম দেওয়াটাও কি-না তার মনে হলো খেলা! তাইতো জন্ম দেওয়া সন্তানকে রাখলেন খোলা আকাশের নিচে। সন্তানকে পুতুল ভেবেই কি-না এমনটা করা- এমন প্রশ্নে মেয়েটির মুখে ‘রা’ নেই। তবে ভয়ের কারণে এমন করার কথায় সায় ছিল তার।
মেয়েটির বয়স ১৩ বছর। ১০ দিন হলো ছেলে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। এখনো সেভাবে সন্তানের যত্ন-আত্তি করতে পারছেন না। কখনো তার বাবা কখনো তার মায়ের কোলে দিয়ে রাখছেন সন্তানকে। নিজে যেন ভাবলেশহীন। তবে একটা ভয় কাজ করছে মেয়েটির মনে। নিজের ও সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে চিন্তা তার মনে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার বুড়িশ্বর ইউনিয়নের দক্ষিণ সিংহগ্রামের ধরহাটির ওই মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হয়ে ছেলে সন্তানের জন্ম দিয়েছে। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি মেয়েটি নিজ বাড়িতে সন্তানের জন্ম দেয়। জন্মের পর পরই বেশ কিছু সময় বাইরে থেকে অসুস্থ হয়ে শিশুটিকে হাসপতালে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলে বাড়িতে নেওয়া হয়েছে।
শুক্রবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) রাতে গ্রামের এক সালিসিতে ধর্ষকের সঙ্গেই মেয়েটির বিয়ের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে মেয়েটির বয়স ১৮ বছর হলে বিয়ে দেওয়া হবে। মেয়েটির নামে লিখে দেওয়া হবে ৩০ শতাংশ জমি। আপাতত মা ও সন্তানের ভরণপোষণ দেওয়া হবে। বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত বাবার বাড়িতেই থাকবেন মেয়েটি। ওই মেয়েটি হরিদাসকে মামা বলে ডাকতো।
এদিকে খবর পেয়ে পুলিশ ওই ‘শিশু মা’ ও অভিযুক্তের বাড়িতে ঘুরে আসে। দুই পক্ষের কথাই তারা শুনেছে। ধর্ষণের শিকার শিশু বা তার পরিবারের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ দিলে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
এলাকাবাসী, পুলিশ ও পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিংহগ্রাম গ্রামের ৫০ বছর বয়সি হরিদাস ভৌমিক নামে ব্যক্তি গাভী থেকে দুধ সংগ্রহ করার জন্য প্রতিদিনই পাশের এক বাড়িতে যেত।
ওই বাড়ির এক শিশুর প্রতি নজর পড়ে হরিদাসের। ভয় দেখিয়ে একাধিকবার তাকে ধর্ষণও করে। ধর্ষণের বিষয়টি না বলার জন্যও ওই শিশুকে হুমকি দেওয়া হয়। শিশুটির পরিবার খুবই গরিব। তারা সিংহভাগ গ্রামে ভাড়া বাসায় বসবাস করত। জন্মনিবন্ধন অনুযায়ী ‘শিশু মা’ এর জন্ম ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি শিশুটি নিজ বাড়িতে ছেলে সন্তানের জন্ম দেয়। এ সময় সে শিশুটিকে বাড়ির বাইরে ফেলে রাখে। বাড়ির পাশের এক নারী শিশুর কান্না শুনে এগিয়ে আসে। তখন বিষয়টি জানাজানি হয়। শিশুটি অসুস্থ হয়ে পড়লে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
বিষয়টি জানাজানি হলে এলাকার লোকজন শুক্রবার রাতে সিংহভাগ গ্রামে বৈঠকে বসেন। তখন মেয়েটি ঘটনার জন্য হরিদাসকে দায়ী করেন। ১২ জনের একটি ‘সালিস বোর্ড’ গঠন করে মেয়েটিকে ১৮ বছর বয়স হলে বিয়ের সিদ্ধান্ত হয়।
পাশাপাশি ৩০ শতাংশ জমি লিখে দেওয়া ও ভরণপোষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে প্রমোদ শাহজি, সুরিমল, অনিল ঘোষ, নির্মল সরকার, রামপ্রসাদ, নিশু সরকার, জীতেন্দ্র সরকারসহ আরো কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন।
ওই ‘শিশু মা’ এর বাবার কাছে শনিবার বিকেলে ফোন করতেই কান্নার শব্দ শুনা যায়। জানতে চাইলে বললেন, ‘আর কার। আমার মাইয়ার বাচ্চা। হারাদিন আমি আর আমার বউ মিল্লা রাখি। আমার মাইয়া ত বাচ্চা পালন কেমনে বুজে না। ’
তিনি আরো বলেন, ‘পেশাগত কারণে আমি বছরের বেশিরভাগ সময় এলাকার বাইরে থাকি। আমার মেয়ে সন্তান জন্মদানের দিনও বাড়িতে ছিলাম না। ওইদিন সকালে যখন সন্তান জন্ম দেয় তখন তার মাও বাড়ির বাইরে ছিল। নিজে নিজেই আমার মেয়ের সন্তান প্রসব হওয়ার পর সে কিছু বুঝে উঠার আগেই বাড়ি নিয়ে ফেলে রাখে।
পাশের বাড়ির এক মহিলা সেটি দেখে আমার স্ত্রীকে খবর দেয়। এরপর শিশুটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। প্রথমে আমার মেয়ে ঘটনার সঙ্গে কে জড়িত সেটা বলতে চাচ্ছিল না। পরে তার মা ভয় দেখিয়ে কথা বের করে। এ সময় সে জানায়, হরিদাস একাধিকবার তার সঙ্গে শারিরিক সম্পর্কে মিলিত হয়। ’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মেয়ে অত্যাধিক মোটা হতে থাকার বিষয়টি আমার চোখে পড়ে। অন্য লোকজন এটা আমাকে বলে। তবে এমন বয়সে এটা হতে পারে ভেবে আমি খুব একটা পাত্তা দেইনি। সন্তান জন্ম দেওয়ার পর বিষয়টি বুঝতে পারলাম।
এলাকার লোকজনকে জানানোর পর এ নিয়ে তারা সালিস বৈঠক করে। বৈঠকে বিয়ে পড়ানো, জমি লিখে দেওয়া ও ভরণপোষণের সিদ্ধান্ত হয়। তবে শেষ পর্যন্ত সেটি বাস্তবায়ন করা হবে কি-না জানি না। হয়তো আমার কাছেই মেয়েটিকে রাখতে হবে। আমি গরিব মানুষ। এ নিয়ে কিছু করার কথাও ভাবতে পারি না। ’
ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য রতন শাহজি বলেন, ‘এ নিয়ে সালিস হওয়ার কথা শুনেছি। আমাকে থাকতে বলা হলেও এলাকায় না থাকায় যেতে পারিনি। আমি মেয়েটির মাকেও বলেছি যে এত বড় বিষয় কেন তারা আগে থেকে খেয়াল করল না। এখন তারা যেভাবে চাইবে সেভাবেই হবে। ’
হরিদাসের ভাই গৌরদাস ভৌমিক শনিবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘ঘটনাটি জেনে আমিও অবাক হয়েছি। ধর্ষণ হয়ে থাকলে ওই পরিবার থেকে আগে আমাদেরকে জানাতে পারতো। সালিসে আমি বলেছিলাম ডিএনএ টেস্ট করাতে। কিন্তু এটা সম্ভব নয় জানিয়ে সালিসকারকরা বিয়ে পড়ানো ও সম্পত্তি দেওয়ার রায় দিয়েছেন। এখন আমরা সেদিকেই এগুবো। ’
নাসিরনগর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. হাবিবুল্লাহ সরকার বলেন, ‘এমন ঘটনা জানতে পেরে এলাকায় পুলিশ পাঠানো হয়। এ বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। মেয়েটির পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ দিলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’