সুগন্ধা ট্র্যাজেডি: নিখোঁজরা ফেরেননি, শনাক্ত হয়নি ২৪ মরদেহ

কামরুন নাহার | ১৮:০১, জানুয়ারি ২৫ ২০২২ মিনিট

নিজস্ব প্রতিবেদক॥ অপেক্ষা যেন ফুরোয় না। এক এক করে ৩০ দিন পেরিয়ে গেছে। নিখোঁজ স্বজনদের পথ চেয়ে আছেন পরিবারের লোকজন। এক মাসেও না ফেরায় স্বজনরা মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেছেন, তারা ফিরবেন না। তারপরও চান সন্ধান, অন্তত লাশ কোথায় সেটি নিশ্চিত হতে সুগন্ধা নদীর পারে কাটে অনেকের সময়। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে বরগুনাগামী অভিযান-১০ লঞ্চ ঝালকাঠির পোনাবালিয়া ইউনিয়নের দেউরী এলাকায় সুগন্ধা নদীতে পৌঁছালে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এক মাস পার হয়েছে। এক মাস পার হয়েছে, এখন পর্যন্ত ৩০ জনের নিখোঁজ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। আর শনাক্ত হয়নি ২৪ লাশের পরিচয়। পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ নমুনা দিয়ে অপেক্ষায় রয়েছেন স্বনজরা।   বরগুনা জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, সুগন্ধা ট্র্যাজেডিতে এখন পর্যন্ত ৪৮ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ২৪ ডিসেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪১ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়। আর চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ছয়জন মারা যান। চলতি মাসের ২ ও ৩ তারিখ ঢাকায় চিকিৎসাধীন দগ্ধ দুজন ও সবশেষ ২১ জানুয়ারি আরও একজন নারী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান। প্রশাসনের হিসাবে, ঘটনার পর বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দগ্ধ ও আহত হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ১০১ জন। এদের মধ্যে ১৯ জনকে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়েছিল। যাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত চার জনের মৃত্যু হয়েছে। বাকিরা নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (আইসিইউতে) চিকিৎসাধীন। নিহত ৪৮ জনের মধ্যে সনাক্ত না হওয়ায় ২৩ জনকে বরগুনায় ও একজনকে ঝালকাঠিতে দাফন করে জেলা প্রশাসন। বাকি ২৪ জনের মরদেহ শনাক্ত করে নিয়ে যান স্বজনরা। ঘটনার পর বরগুনা জেলা প্রশাসন নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা করে। ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত জেলা প্রশাসনকে ৩০ জনের নিখোঁজ থাকার তথ্য দিয়েছেন স্বজনরা। গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ শুরু করে। তিন দিনের নিখোঁজ ৩০ জনের বিপরীতে ৪৮ জন স্বজনের নমুনা সংগ্রহ করে দলটি। সে সময় সিআইডির নমুনা পরীক্ষক রবিউল ইসলাম জানিয়েছিলেন, পরীক্ষার ফল পেতে এক মাসের বেশি সময় লাগতে পারে। ঘটনার এক মাস পূর্ণ হলেও নিখোঁজ ব্যক্তিদের কোনো তথ্য জানতে পারেননি স্বজনরা। এখনো অনেকেই শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এ ছাড়া পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন অনেকে। এদের মধ্যে কয়েকজন নারী ও শিশু রয়েছেন, যারা অভিভাবকহীন অবস্থায় আত্মীয়—স্বজনদের আশ্রয়ে রয়েছেন। বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার চরদুয়ানী ইউনিয়নে ছোট টেংরা গ্রামের আফজাল হোসেনের মেয়ে ফজিলা আক্তার পপির এখনো খোঁজ মেলেনি। পপির মেয়ে লামিয়া তার নানা আফজাল হোসেনের কাছে রয়েছেন এক মাস থেকে। ১১ বছরের লামিয়া অপেক্ষা করছেন মা আসবে কবে। আফজাল বলেন, ‘মেয়ে হারানোর শোক আর নাতনির ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি চিন্তিত। আমি মারা গেলে আমার নাতনিকে কে দেখভাল করবে?’ বরগুনা সদর উপজেলা বুড়িরচর ইউনিয়নের হাকিম শরীফ, তার স্ত্রী পাখী বেগম ও শিশুসন্তান নাসরুল্লাহ এখনও নিখোঁজ। হাকিম শরীফের তিন সন্তান ১৮ বছরের হাফসা বেগম, ১৪ বছরের সুমাইয়া আক্তার ও ১০ বছরের ফজলুল হক এখন অভিভাকহীন। তাদের দেখভাল ও ভরণ পোষণের জোগান দেয়ার কেউ নেই। হাফসা বলেন, ‘আত্মীয়-স্বজনদের সহায়তায় এহন মোগো তিন ভাইবুইনের খাওন পরন চলে। এই রহম কতদিন কেডা মোগো দ্যাকপে। কেউ আইস্যা এট্টু খোঁজ নেয়নাই, মোরা খাই নাকি না খাইয়া থাহি।’ বরগুনা সদর উপজেলার মোল্লাহোরা গ্রামের বাসিন্দা সুমন সরদার। ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তার স্ত্রী তাসলিমা, দুই মেয়ে সুমাইয়া আক্তার ও সুমনা আক্তার এখনো নিখোঁজ। সুমন বলেন, ‘যাগো কবর দিয়া দেছে হেইয়ার মইদে মোর বউ মাইয়া পোলার কবর আছে কিনা, এহন খালি হেইডা জানতে অপেক্ষা করতে আছি। কবরডাও যদি দেহাইয়া দেতে পারত হেরা, তয় মুই কতকুন কাইন্দা কাইট্টা শান্ত্বনা পাইতাম।’ জেলা প্রশাসন জানায়, নিহদের মধ্যে শনাক্ত হওয়া ২৪ পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে। তবে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের কোনো সহায়তা এখনো দেয়া হয়নি। বরগুনা জেলা নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন কামাল মনে করেন, লঞ্চে আগুনের ঘটনায় নিখোঁজ পরিবারগুলোর মধ্যে যারা অসহায় আছেন, রাষ্ট্রের উচিত তাদেরকে আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা দেয়া। তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর মধ্যে অনেক নারী ও শিশু এখন অভিভাবকহীন, কেউ কেউ আর্থিক টানপড়েনে মানবেতন জীবনযাপন করছেন। আমি মনে করি এই পরিবারগুলোর সুরক্ষায় রাষ্ট্রের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।’ বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘শনাক্ত হওয়া মরদেহের স্বজনদের আমরা প্রাথমিকভাবে ২৫ হাজার করে টাকা আর্থিক সহায়তা দিয়েছি। আমরা ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা পেলেই ঠিক কতজন নিখোঁজ আছে, এটা শনাক্ত ও নিখোঁজ ব্যক্তিদেও পরিবারগুলোকে চিহ্নিত করতে পারব। ‘এরপর ‘সোশ্যাল সেফটি নেটের আওতায়’ বিশেষভাবে তাদের সহায়তার আওতায় আনা হবে। তবে তাদের সহায়তায় এখনো পর্যন্ত আলাদা কোনো কার্যক্রমের নির্দেশনা এখনো পাওয়া যায়নি।’