নৌ-দুর্ঘটনা ফান্ডের অর্থ থেকে বঞ্চিত অধিকাংশ যাত্রীরা
দেশ জনপদ ডেস্ক|২০:১২, ডিসেম্বর ২৭ ২০২১ মিনিট
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ যাত্রীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই চলছে ঢাকা-বরিশাল নৌরুটের বিলাসবহুল লঞ্চগুলো। এসকল লঞ্চে যাত্রীর কাছ থেকে ভাড়ার সাথে নেয়া হচ্ছে নৌ-দুর্ঘটনা ফান্ডের নামে টাকা।
তবে এ ফান্ড সম্পর্কে কোন তথ্যাই জানে না সাধারণ যাত্রীরা। বছরে প্রায় কয়েক কোটি টাকা নৌ-দুর্ঘটনা ফান্ডের নামে উধাও হয়ে যাচ্ছে। নৌ-দুর্ঘটনা ঘটলে দেখা যায় বিভিন্ন নৌযান মালিক ও নেতাকর্মীরা তাদের নামে সাহায্য দিচ্ছেন।
তাহলে প্রশ্ন হলো নৌ-দুর্ঘটনা ফান্ডের নামে যাত্রী প্রতি নেয়া ১৫ টাকা কোথায়। এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে অনুসন্ধান করেও কোন সদুত্তর মেলেনি। নৌ-দুর্ঘটনা ফান্ডে যাত্রীদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের ব্যাপারে জানে না দুর্ঘটনায় কবলিত যাত্রীরা। এমনকি নৌ-দুর্ঘটনা ফান্ডের সম্পর্কিত কোন তথ্যাবলি নেই বরিশাল আধুনিক নৌবন্দরে। যে কারণে অধিকাংশ সময়ই ঢাকা-বরিশাল নৌ-পথে দুর্ঘটনাকবলিত যাত্রীরা বরাদ্দকৃত আর্থিক ফান্ড থেকে সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছেন।
সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছর নৌ-দুর্ঘটনা ফান্ডের জন্য লঞ্চগুলো থেকে যাত্রী ধারণ ক্ষমতার সংখ্যা অনুযায়ী ১৫ টাকা হারে আদায় করে নৌ-বন্দর কর্তৃপক্ষ। বরিশাল আন্তঃজেলা রুটে একতলা লঞ্চ চলাচল করে ২০/২৫টি এবং বরিশাল-ঢাকা রুটে তিনতলা লঞ্চ চলাচল করে ১৫/২০টি। প্রতি বছর নৌ-বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এ নৌযানগুলোকে নবায়ন সনদ নিতে হয়। এর মধ্যে কীর্ত্তনখোলা, সুরভী, সুন্দরবন, মানামি, এ্যাডভেঞ্চার, পারাবত, কুয়াকাটা ও টিপুসহ ঢাকা রুটের এ লঞ্চগুলোর ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী যাত্রীবহনে প্রতিটি লঞ্চে অনুমোদন রয়েছে ১ হাজার থেকে ১৬শ জনের। অপরদিকে বিভিন্ন আন্ত:জেলা রুটে একতলা লঞ্চগুলোর ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী প্রতিটি লঞ্চে যাত্রীবহনে অনুমোদন রয়েছে ১শ থেকে ১৫০ জন।
সে হিসেব অনুযায়ী গড়ে ১২শ’ যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ২০টি তিন তলা নৌযান থেকে প্রায় ৫ লাখ এবং ২৫টি এক তলা লঞ্চ থেকে গড়ে ৮০ জন যাত্রী হিসেবে আদায় করে ৩০ হাজার টাকা। নৌ-দুঘর্টনা ফান্ডের আদায়কৃত টাকা দুর্ঘটনাকবলিত যাত্রীদের প্রয়োজনে ব্যয় করা হয়। কিন্তু নৌ-দুর্ঘটনা ফান্ডে বরাদ্দকৃত টাকার ব্যাপারে না জানার কারণে এ সুবিধা পাচ্ছে না দুর্ঘটনা কবলিত অধিকাংশ যাত্রীরা। এছাড়াও খরচ কমানোর জন্য বর্তমানে বরিশাল ঢাকা লঞ্চের কর্তব্যরত আনসার সদস্যদেরও উঠিয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানাগেছে। এ নৌরুটে প্রতিদিন গড়ে ২৫-৩০ হাজার যাত্রী চলাচল করেন। এসব যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য অতীতে প্রত্যেক লঞ্চে ১১ জন করে সশস্ত্র আনসার বাহিনীর সদস্য দায়িত্ব পালন করতেন। বর্তমানে এ রুটের কোনো লঞ্চেই আনসার সদস্য নেই।
কারণ লঞ্চের মালিকরা ব্যয় কমাতে কৌশলে আনসার বাহিনীকে এড়িয়ে চলছেন। আনসার সদস্যের পরিবর্তে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে লাঠি নিয়ে দায়িত্ব পালন করা নিরাপত্তাকর্মী। কারণ একজন আনসার সদস্যের বেতনের টাকা দিয়ে লঞ্চ মালিকরা চার জন নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ দিতে পারেন। তাই ব্যয় কমাতে যাত্রী নিরাপত্তার কথা ভুলে মাত্র তিন-চারজন নিরাপত্তাকর্মী দিয়ে দায়িত্ব পালন করানো হচ্ছে। কিন্তু সেই নিরাপত্তাকর্মীরা যাত্রীদের নিরাপত্তা না দিয়ে অবৈধভাবে অর্থ আদায় করছেন। বেতন কম হওয়ায় লঞ্চের ডেকে চাদর দিয়ে জায়গা দখল করে পরে আবার সেই জায়গা চড়া দামে বিক্রি করে করছেন তারা। তাছাড়া পুরো লঞ্চে নিরাপত্তার জন্য কমপক্ষে ৪০টি ক্যামেরা স্থাপনের দরকার হলেও অধিকাংশ লঞ্চে রয়েছে মাত্র ১০-১২টি ক্যামেরা।
যে ক্যামেরা আছে তাও সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হয় না। সূত্র মতে, সম্প্রতি অভিযান ১০ লঞ্চের ভয়াভহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় আবারো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর। এ দুর্ঘটনায় প্রায় অর্ধশতাধিক প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেছে। এছাড়ও গত তিন বছরে ঢাকা-বরিশাল রুটে নৌযানগুলোর মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত হয়েছে অন্তত শতাধিক যাত্রী এবং আহত হয়েছে পাঁচ শতাধিক যাত্রী। গভীর রাতে নৌযানগুলোর অসুস্থ প্রতিযোগীতা আর ডুবোচর এবং ঘন কুয়াশাই এই দুঘর্টনার কারণ। এছাড়াও যাত্রীদের নিরাপত্তায় যেসব সামগ্রী রয়েছে তা খুবই সীমিত। নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক লঞ্চে লাইফ বয়া ২৫০টি, ফায়ার বাকেট ২৫টি, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ২৫টি ও একটি বালির বাক্স থাকার কথা রয়েছে। কিন্তু সরজমিনে এসব নিরাপত্তা সামগ্রী দেখা গেলেও যাত্রীদের ধারণ ক্ষমতার তুলনায় তা খুবই সামান্য।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) বরিশাল বন্দর ও পরিবহণ বিভাগের উপ-পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, প্রতিটি লঞ্চ ঘাট ত্যাগ করার পূর্বে আমরা চেক করে দেখি সব ঠিকঠাক আছে কিনা। যদি লঞ্চে কোন সমস্যা পাই তবে সাথে সাথে সেটার সমাধান করে লঞ্চ ঘাট ত্যাগ করার অনুমতি দেই। তিনি আরো বলেন, নৌদুঘর্টনা ফান্ডের ব্যাপারটি কেন্দ্রীয় অফিস নিয়ন্ত্রণ করে। এ ব্যাপারে তেমন কোন তথ্য আমাদের কাছে নেই। আর দুর্ঘটনার পর নিহত-আহতদের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে তাৎক্ষণিকভাবে আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়।
আনসার সদস্যের বিষয়ে তিনি বলেন, আনসার সদস্যদের বেতন লঞ্চ মালিকরা বহন করে তাই এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না। এদিকে কাগজে কলমে ধারণ ক্ষমতানুসারে নৌ-দুঘর্টনা ফান্ডের টাকা নেয়া হয়। অথচ সরেজমিনে প্রতিটি নৌযান ধারণ ক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি যাত্রী বহন করছে। ফলে নৌ-দুঘর্টনার ফান্ডে জমাকৃত টাকা ফাঁকি দিচ্ছে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ। যা কতৃপক্ষ ব্যক্তিগত লাভবান হওয়ার স্বার্থে দেখেও না দেখার ভান করছে। অপরদিকে দুর্ঘটনা কবলিত যাত্রী আউয়াল সিকদার বলেন, আমি ঢাকা থেকে বরিশাল আসার পথে পারাবত লঞ্চে দুর্ঘটনার শিকার হই। এতে আমার হাত-পা ও পিঠে জখম হয়। কিন্তু আমি জানিনা যে, যাত্রী দুর্ঘটনা ফান্ড আছে। জানলে সহায়তার জন্য দারস্থ হতাম। এতে আমার আর্থিক ক্ষতি কিছুটা হলেও লাঘব হতো।
তিনি আরো বলেন, নৌ-বন্দর কর্তৃপক্ষের যাত্রী দুঘর্টনা ফান্ডের এ বিষয়টি হটলাইন চালুর মাধ্যমে জানানো উচিত। এছাড়া দুঘর্টনার সময় সুরক্ষার জন্য লঞ্চগুলোতে নৌ-বন্দর কর্তৃপক্ষের কোন যোগাযোগ নাম্বার নেই। এমনকি ফায়ার সার্ভিস বা নৌ-পুলিশেরও কোনো নাম্বার নেই, যে আপদকালীন সময়ে ফোন করে প্রাণে বাঁচার সাহায্য জানাবো। তবে ভুক্তভোগী যাত্রীদের এমন চিন্তার বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা জানতে সরেজমিন সূত্রে জানা গেছে, কোন লঞ্চেই এ ধরণের সুবিধা নেই। কেউ হয়তো মোবাইল থেকে অনলাইন সুবিধার মাধ্যমে নৌবন্দর কর্তৃপক্ষ বা ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য মাধ্যমে জানালেও মাঝ নদীতে নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে পারা যায় না।
অভ্যন্তরীণ লঞ্চ মালিক সমিতির সহ-সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, আনসার সদস্যদের বেতন অনেক বেড়ে যাওয়ার কারণে সকল লঞ্চ মালিকের পক্ষে তাদের রাখা সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেন, যদি ২শত লোকের জন্য সরকার পুলিশ দিতে পারে তাহলে প্রতিটি লঞ্চে প্রায় দেড় হাজার যাত্রী থাকে সেখানে কেন সরকার পুলিশ দিতে পারে না। প্রয়োজনে পুলিশ সদস্যদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা লঞ্চ মালিকরা করবে।
তিনি আরো বলেন, এ নিয়ে একাধিকবার আনসার কর্মকর্তাদের সাথে আমরা বৈঠক করেছি। কিন্তু তারা বেতন ছাড়া দিতে পারবেনা বলে জানিয়েছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নৌ-দুর্ঘটনা ফান্ডে বরাদ্দকৃত টাকার হিসাব কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে থাকে। আমারা যে সহযোগীতা করি তা এ ফান্ড থেকেই করি। এটা আমাদের কোন ব্যক্তিগত টাকা নয়। অপরদিকে বরিশাল আধুনিক নৌ-বন্দরে ট্রাফিক বিভাগের কর্তাব্যক্তি ও বন্দর কর্মকর্তা একজন হওয়ায় ট্রাফিক কার্যক্রমে পুরোমাত্রায় বাস্তবায়নে ধীর গতি রয়েছে। যে কারণে ঢাকা-বরিশাল নৌপথটি এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে বলে মনে করনে সচেতন মহল।