করোনার স্টিকার লাগিয়ে থ্রি-হুইলার থেকে চাঁদাবাজি

দেশ জনপদ ডেস্ক | ০০:১২, ডিসেম্বর ১৯ ২০২১ মিনিট

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে সচেতনতামূলক স্টিকার লাগিয়ে নগরীর সবগুলো সিএনজি-মাহেন্দ্র থেকে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। একই লেখা, একই কালার এবং একই স্টিকার বসানো হয়েছে সবগুলো সিএনজি ও মাহেন্দ্রার সামনের গ্লাসের উপর। যাতে সমিতির লোকজন এবং দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ সহজেই চিনতে পারে থ্রি-হুইলারটি তাদের চাঁদার আওতায়। কারণ মালিক সমিতি কিংবা শ্রমিক ইউনিয়নের নামে আদায়কৃত চাঁদার বড় একটি অংশ দেয়া হয় ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তাদের মাঝে। সূত্রমতে, মাঠ পর্যায়ে শ্রমিকদের কল্যাণ তহবিলের নামে প্রতি মাসে মনিরুল ইসলাম অনু’র নেতৃত্বে এই চাঁদা উত্তোলন করে সমিতির নির্ধারিত কয়েকজন। এ বিষয়ে মুঠোফোনে অনু বলেন, সিএনজি-মাহেন্দ্র থেকে যে টাকা উত্তোলন করা হয় তার অধিকাংশই আ’লীগের বিভিন্ন প্রোগামে খরচ করা হয়। চলতি মাসে আ’লীগের পার্বত্য শান্তিচুক্তি প্রোগ্রামে ৪৫০টি সিএনজি-মাহেন্দ্র কর্মীদের আনা-নেয়ার জন্য দেয়া হয়েছে। ভাড়া এখনো পরিশোধ করতে পারিনি। এই মাসে যে চাঁদা আদায় হচ্ছে সেখান থেকে ভাড়া পরিশোধ করছি। চাঁদার টাকা ট্রাফিক পুলিশের টিআই কিংবা সার্জেন্টদের দেয়া হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, না তাদের দেয়া হয় না। ট্রাফিক পুলিশের অফিসে একেবারে গোড়ায় দেয়া হয়। তাহলে আদায়কৃত চাঁদা শ্রমিকদের কি কল্যাণে আসে? এমন প্রশ্নের কোন সদুত্তর না দিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যান তিনি। এমন অভিযোগের বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ট্রাফিক পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার তানভীর আরাফাত বলেন, কোন গাড়ী চালকের কাছ থেকে চাঁদা তোলা হলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর সাথে যদি কোন পুলিশ সদস্য জড়িত থাকে এবং প্রমাণ পাওয়া যায় তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক বিভাগীয় ব্যবস্থ গ্রহণ করা হবে। মনিরুল ইসলাস অনু’র নেতৃত্বে চাঁদা উত্তোলনের বিষয়ে এই কর্মকর্তা ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, আমাদের ট্রাফিক অফিসে কোন চাঁদা নেয়া হয় না। আমি তার বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এদিকে করোনার নামে যে সচেতনতামূলক স্টিকার লাগানো হয়েছে আসলে স্টিকারগুলো সচেতনতামূলক নয়, এগুলো ব্যবহার করে প্রত্যেক সিএনজি ও মাহেন্দ্রা থেকে টাকা উঠানো হয় এমনটি জানিয়েছে ভুক্তভোগী একাধিক ড্রাইভার। তারা বলেন, প্রত্যেক মাসে মালিক সমিতি প্রত্যেক সিএনজি ও মাহেন্দ্রা থেকে এই স্টিকার দিয়ে পাঁচশত টাকা করে চাঁদা আদায় করে। মালিক সমিতির স্টিকার না লাগালে ধরে নিয়ে সার্জেন্টের হাতে মামলা দেয়া হয় এবং সমিতির লোকজন দিয়ে আমাদের উপর হামলা চালানো হয়। এছাড়াও স্ট্যান্ড ফি বাবদ ত্রিশ টাকা আদায় করে। নগরীতে বিশেষ এই সাংকেতিক স্টিকার ছাড়া কোন সিএনজি-মাহেন্দ্রা চলতে পারে না বলে দাবী চালক ও মালিকদের। ভুক্তভোগীরা বলেন, থ্রি হুইলার মালিক সমিতি সাংকেতিক এই স্টিকারের চিহ্ন দিয়ে মেট্রোতে পাঁচশত এবং জেলায় আটশত টাকা আদায় করে। সমিতির লোকজন শহরের বিভিন্ন স্ট্যান্ডে সংঘবদ্ধভাবে অবস্থান করে। এদের কাজ হচ্ছে যেসব সিএনজি ও মাহেন্দ্রার স্টিকার নেই তাদের খুঁজে বের করা। এরপর পুলিশের ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক সমিতির নির্ধারিত সাংকেতিক স্টিকার লাগিয়ে দেয়। এছাড়া শ্রমিক ইউনিয়ন (রেজিঃ নং-খুলনা-৫১৭) প্রতিদিন বিশ টাকা করে চাঁদা আদায় করে। সূত্র জানা গেছে, বরিশাল জেলা ট্যাক্সি, অটোরিক্সা, অটো টেম্পু থ্রী হুইলার শ্রমিক ইউনিয়ন (রেজিঃ নং-৫১৭) এর তিন বছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে সংগঠনটির সদস্য সংখ্যা ছিলো ১৫০১ জন। নির্ধারিত সদস্যদের কাছ থেকে ওই অর্থ বছরে আয় হয়েছে মোট ৯০ লাখ ৬ হাজার টাকা। যেখানে কেবলমাত্র কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৬০ লাখ টাকা। এরপর ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে সংগঠনের সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে ১৬৩০ জন। নির্ধারিত সদস্যদের কাছ থেকে ওই অর্থ বছরে আয় দেখানো হয়েছে ৯৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সেখানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৭২ লাখ টাকা। সর্বশেষ ২০২০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনেও সদস্য সংখ্যা দেখানো হয়েছে ১৬৩০ জন। তবে করোনা মহামারির অজুহাতে আয় কমিয়ে সর্বমোট দেখানো হয়েছে ৪৮ লাখ ৯০ হাজার টাকা। ওই অর্থবছরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ৩৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০১৮-২০২০ সাল পর্যন্ত তিন অর্থ বছরে সংগঠনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদ মোট খরচ দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। সংগঠনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ও অফিস ভাড়ার নামে লোপাট করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা। শ্রম দফতরে দাখিলকৃত বার্ষিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চালচিত্র। অপরদিকে, নগরীর চাঁদমারিস্থ এলাকায় বরিশাল জেলা মিশুক, বেবি ট্যাক্সি, ট্যাক্সি কার, সিএনজি (এলপি গ্যাস চালিত) শ্রমিক ইউনিয়ন (রেজিঃ নং ২২৫৬) সংগঠনটিতে ২০১৮ সালের অর্থবছরে ১১৪ জন সদস্যের বিপরীতে আয় দেখানো হয়েছে ৩ লাখ ৪২ হাজার টাকা। অপরদিকে ২০১৯-২০ সালের অর্থ বছরে ওই একই সদস্য সংখ্যার বিপরীতে আয় হয়েছে ১০ লাখ ২৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ সংগঠনের সদস্য সংখ্যা একই থাকার পরও দুই অর্থ বছরের আয়ের বিবরণীতে ব্যাপক গড়মিল পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে জানতে সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এর সাথে একাধিকবার মোবাইলে যোগাযোগ করা হলেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে এ নিয়ে বরিশাল আঞ্চলিক শ্রম দপ্তরের উপ-পরিচালক ওসমান গনি বলেন, থ্রী হুইলার শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে আয়-ব্যয়ের যে রির্পোট প্রদান করা হয় সেসকল তথ্যাবলির উপরই আমাদের অনেকাংশে নির্ভর করতে হয়। কারণ আমাদের জনবল সংকট থাকায় যাচাই বাছাইয়ের সুযোগ কম। কিন্তু সংগঠনগুলোর আয়-ব্যয়ে যদি কোন প্রকার গড়মিল কিংবা দুর্নীতি নিয়ে খবর প্রকাশিত হয় তাহলে কি তদন্ত করা হবে কিনা জানতে চাইলে উপ-পরিচালক আরো বলেন, অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে এবং সত্যতা পেলে ওই সংগঠনের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে মামলাও হতে পারে। একই চিত্র দেখা গেছে থ্রি-হুইলার মালিক সমিতি নামে অপর সংগঠনের বেলায়ও। যদিও সংগঠনের কোন রেজিষ্ট্রেশন নম্বর খুঁজে পাওয়া যায়নি আঞ্চলিক শ্রম দফতর অফিসে। তবে সংগঠনের মূল হোতা মনিরুল ইসলাস অনু’র নেতৃত্বে এই টাকা চাঁদা উত্তোলন করা হয় এমনটাই জানিয়েছে ভুক্তভোগীরা। সূত্র জানা গেছে, নগরীতে রেজিস্ট্রেশনভুক্ত থ্রি-হুইলারের সংখ্যা ৩০৪২টি ও জেলায় ১৫১৩টি। মোট বৈধ ৪৫৫৫টি সিএনজি-মাহেন্দ্র থেকে প্রায় ত্রিশ লক্ষ টাকা চাঁদা উত্তোলন করে সংগঠনটি। ট্রাফিক বিভাগের অসাধু পুলিশ এর সাথে জড়িত রয়েছে বলে দাবী তার। তবে এ ব্যাপারে পুলিশ কমিশনার মোঃ শাহবুদ্দিন খান হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ড্রাইভারদের কাছ থেকে মালিক সমিতির নামে কিংবা শ্রমিক ইউনিয়নের নামে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হচ্ছে, এমন অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। এ বিষয়ে জোড়ালো তদন্ত চলছে। শীঘ্রই দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে। প্রচলিত আইনে রয়েছে, রাস্তায় কোন চালকের কাছ থেকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন টাকা নেয়াই চাদাঁবাজি। বিগত দিনে এ ধরনের অভিযোগ আসলে পুলিশ সাথে সাথে ব্যবস্থা নিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও নেবে। তিনি আরো বলেন, পুলিশের প্রধান শক্তি হলে সাক্ষ্য প্রমাণ। কিন্তু অনেক সময়ে তদন্তে গেলে কোন সাক্ষী পাওয়া যায় না। যে কারণে দোষীদের ছেড়ে দিতে হয়। তিনি আরো বলেন, বরিশালের সাংবাদিকরা অনেক দায়িত্ববান। এ বিষয়ে তিনি সাংবাদিকদের সহযোগীতা কামনা করেছেন।