আজ জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী

কামরুন নাহার | ০০:৩৩, মার্চ ১৭ ২০২০ মিনিট

মোস্তাফিজুল আলম সজীব ॥ আজ জাতির জনক স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। ১৯২০ সালের এই দিনে (১৭ মার্চ) গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহন করেন জাতির পিতা। তার পিতা শেখ লুৎফর রহমান মূলত একজন সাধারন মধ্যবিত্ত গৃহস্থ পরিবারের সদস্য। তিনি ধার্মিক এবং আদর্শ চিন্তার লোক ছিলেন, পুত্র শেখ মুজিবকেও সেভাবে মানুষ করার চেষ্টা করেন। শেখ মুজিব জীবনে নেতৃত্ব করার কপালটিপ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন। স্কুল-কলেজে পাঠ্যাবস্থাতেই রাজনৈতিক আদর্শপুত হয়ে পড়েন। পরে কলকাতায় উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে গিয়ে সেখানে ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেন এবং জাতীয় পর্যায়ে নেতাদের সাহচর্য লাভ করেন। বর্তমান প্রজন্ম হয়ত কল্পনাও করতে পারবে না যে কত বাঁধার বিন্ধ্যাচল পার হয়ে, প্রতীক্ষার কত দীর্ঘ রক্তাক্ত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে, জাতি হিসেবে আমরা আজ সাড়ম্বরে উদযাপন করতে যাচ্ছি প্রিয় নেতার জন্মশতবার্ষিকী। রাষ্ট্র অবনত চিত্তে শ্রদ্ধানিবেদন করবে তার প্রতিষ্ঠাতার প্রতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নয়। একটি ইতিহাস। এই বাংলাদেশে দল-মত নির্বিশেষে তিনি সবার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এক প্রস্ফুটিত গোলাপ। প্রজ্বলিত এক নক্ষত্র। সারা জীবন বঙ্গবন্ধুর এই এক স্বপ্ন, বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। একটিই সাধ বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষের মুক্তি, স্বাধীনতা। এ জন্যই স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে বুক চিরে বেরিয়ে আসা কথাগুলো এভাবে বললেন, ‘আমি আজ বাংলার মানুষকে দেখলাম, বাংলার মাটিকে দেখলাম, বাংলার আকাশকে দেখলাম, বাংলার আবহাওয়াকে অনুভব করলাম। বাংলাকে আমি সালাম জানাই, ‘আমার সোনার বাংলা, তোমায় আমি বড় ভালোবাসি বোধ হয় তার জন্যই আমায় ডেকে নিয়ে এসেছে।’ বঙ্গবন্ধুর চোখে তখন ভেসেছিল সাড়ে সাত কোটি বাংলার মানুষ। একটি বাংলাদেশ। জন্মের শত বছর পরেও তিনি তার আদর্শে আজও ভাস্বর হয়ে আছেন এই বাংলার মাটি ও মানুষের সঙ্গে। ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে। এ কারণেই বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক-অভিন্ন। কবি-মনীষী অন্নদাশঙ্কর রায় বাংলাদেশের আরেক নাম রেখেছেন ‘মুজিব ল্যান্ড’। শোষক ও স্বেচ্ছাচারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে বঙ্গবন্ধু পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির শৃঙ্খলা থেকে তিনি বাঙালি জনগোষ্ঠীকে মুক্ত করে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আর জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সেই স্বপ্ন তিনি বাস্তবায়ন করেছেন। এ মুক্তির সংগ্রামে তিনি নিজের জীবনকে তুচ্ছ করেছিলেন। কিশোর বয়স থেকেই প্রতিবাদী ছিলেন। সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের কথা বলেছেন। সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে তিনি কখনও দূরে সরে যাননি। ভীতি ও অত্যাচারের মুখেও সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের পথে থেকে শোষিত মানুষের অধিকারের কথা বলেছেন। আর এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন গণতন্ত্রের অতন্দ্র সৈনিক। কৈশোর থেকেই তিনি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে ছিলেন সোচ্চার। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আটান্নর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা-আন্দোলন, ছিষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ- প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন নেতৃত্বের ভূমিকায়। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রধান শক্তির উৎস ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে তিনি ছিলেন সর্বদা বজ্রকণ্ঠ। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের তার ভাষণ গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে, স্বাধিকারের পক্ষে, স্বাধীনতার পক্ষে এক ঐতিহাসিক দলিল। ওই ভাষণ একটি জাতিকে জাগ্রত করেছে, একবিন্দুতে মিলিত করেছে। এমন ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নাম চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। একটি স্বাধীন ভূমির জন্য বঙ্গবন্ধু অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। বছরের পর বছর তাকে কারাগারে কাটাতে হয়েছে। দেশের প্রতি, দেশের মাটির প্রতি তার ভালোবাসা ছিল বলেই তিনি এটা পেরেছেন। শোষিত মানুষের পক্ষে নির্ভীক অবস্থানের কারণে তিনি কেবল বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পান। ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ, যেখানে তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন- ‘বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত, এক পক্ষে শোষক, আরেক পক্ষে শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’শোষিত মানুষের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর এই অবস্থান বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়। বিশ্বের শোষিত-নির্যাতিত মানুষ বঙ্গবন্ধুকে গ্রহণ করে নেয় নিজেদের নেতা হিসেবে। বাঙালি জাতিকে দীর্ঘদিনের শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্ত করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে একটি মর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে। দেশ ও জাতি গঠনে জাতির পিতার কর্মতৎপরতা এবং চিন্তা-ভাবনাই আমাদের অনুসরণীয় আদর্শ। ব্যক্তিস্বার্থ, লোভ, মোহ, পদ-পদবির ঊর্ধ্বে এ আদর্শের মূলে রয়েছে ত্যাগ-তিতিক্ষা আর আন্দোলন-সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে খুব সংক্ষেপে তুলে ধরা যায় এভাবে- ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়া, অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ-প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলা আর মানুষের জন্য ভালোবাসা। আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধি, আত্মসমালোচনা, সমাজের সর্বস্তরে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, সমাজ থেকে দুর্নীতি নির্মূল ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী অবশ্যই এদেশের মানুষের কাছে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা? এ উপলক্ষে ২০২০ ও ২১ সালকে মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ২০১৯ সালের ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের যৌথ সভায় মুজিব বর্ষ উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত সরকার মুজিব বর্ষ উদ্যাপন করবে। দেশের ভেতর ছাড়াও বাইরে উদ্যাপিত হবে জন্মশতবার্ষিকী ও মুজিব বর্ষের আনন্দ আয়োজন। জন্মশতবার্ষিকীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি হবে আজ ১৭ মার্চ। বড় পরিসরে অনুষ্ঠানটি করার কথা থাকলেও করোনাভাইরাস বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ায় এখন ছোট পরিসরে অনুষ্ঠানটি উদ্যাপন করা হবে। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। এদিকে, ইউনেস্কোও বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে বঙ্গবন্ধুর জন্ম বার্ষিকী উদযাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় ঘটনাটি একটি আর্ন্তজাতিক মাত্রা পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই আয়োজনে সব বয়স ও শ্রেণি পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করার আহ্বান জানিয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠান, জুলি ও কুরি পদকপ্রাপ্তি দিবস উদ্যাপন, সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বড় আকারে একটি অনুষ্ঠান এবং ১৯৭১ সালে যেসব ভারতীয় যোদ্ধা বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন, তাঁদের মধ্য থেকে একটি প্রতিনিধিদলকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানানোর পরিকল্পনা করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দেশ-বিদেশের বাঙালি-অধ্যুষিত প্রতিটি প্রান্ত ছুঁয়ে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হবে পিতা ও নেতার বজ্রকণ্ঠ বাণী। জনতার হৃদয় উজাড় করা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় ভিন্নতর মাত্রায় স্পর্শাতীত এক উচ্চতায় অধিষ্ঠিত হবেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।