করোনা ঠেকানোর প্রস্তুতি নেই বরিশালের নৌ পথে

কামরুন নাহার | ০০:১১, মার্চ ১৫ ২০২০ মিনিট

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ দেশে ৩ জন করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই দেশজুড়ে করোনাভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। বেশিরভাগ মানুষ ও সংস্থা কোভিড-১৯ মোকাবেলায় প্রস্তুতি জোরদার করেছে। কিন্তু বিশ্বে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনাভাইরাস মোকাবেলায় আমাদের দেশের নৌ-বন্দর ও নৌযানগুলো কতটুক প্রস্তুত? এ প্রশ্ন ক্রমেই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। সরকার জনসমাগম এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিলেও একেকটি লঞ্চ শত শত যাত্রী নিয়ে গন্তব্যে ছুটছেন। নৌবন্দরগুলোতেও গাদাগাদি অবস্থা। এ ক্ষেত্রে যাত্রীরাও অনেকটা নিরুপায়। মানুষকে সচেতন করতে কিছু কিছু প্রচার চালানো ছাড়াও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি কোনো পক্ষকেই। একজন যাত্রী শঙ্কা প্রকাশ করে বলে, লঞ্চ যাত্রীদের কারো দেহে যদি এই ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায় তাহলে এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। তখন পরিস্থিতি সামাল দেয়াই কঠিন হয়ে পড়বে। সূত্র জানায়, প্রতিদিন নৌযানে করে অন্তত ২০ লাখ যাত্রী চলাচল করলে করোনা আতঙ্কে এই রুটে যাত্রী সংখ্যা এখন কিছুটা কমেছে। এ বিষয়ে কথা হয় লঞ্চ মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় নেতা এবং সুন্দরবন নেভিগেশনের মালিক সাইদুর রহমান রিন্টুর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘কেবলমাত্র বরিশাল বিভাগের ৩৮টি রুটে প্রতিদিন শতাধিক ট্রিপল ডেকার লঞ্চ ঢাকায় যাতায়াত করে। এসব লঞ্চে যাত্রী সংখ্যা ২ লাখের বেশি। লঞ্চ মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি বদিউজ্জামান বাদল বলে, ‘ঢাকা সদরঘাট থেকে দেশের অন্তত ৬০টি রুটে চলাচল করে ১২শ’র বেশি বড় লঞ্চ। প্রতিটি লঞ্চ কমপক্ষে ২- ৩ হাজার যাত্রী পরিবহনে সক্ষম। দেশের বিভিন্ন রুটে এসব লঞ্চে দৈনিক যাতায়াত করে ১৫- ২০ লাখ মানুষ। অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলকারী এমএল টাইপের যাত্রীবাহী ছোট নৌ-যানগুলো ধরলে লঞ্চনির্ভর মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে ২০-২৫ লাখ। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে এ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কোনো দফতর। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখাসহ লঞ্চে কর্মরতদের নানাভাবে সাবধান করা হলেও এতে কতটুকু ফল পাওয়া যাবে সেটাই বুঝতে পারছি না।’ কথা হয় নিয়মিত ঢাকা-ভোলা রুটে চলাচলকারী ভোলা শহরের বাসিন্দা আফজাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রতিনিয়ত সরকার বলছে জনসমাগম এড়িয়ে চলতে। অথচ দেশের এমন কোনো লঞ্চ ঘাট পাওয়া যাবে না যেখানে লঞ্চ ছাড়া এবং ঘাটে নোঙ্গর করার সময় শত শত মানুষের উপস্থিতি থাকে না। ভোলা-বরিশালসহ বড় বড় নৌ-বন্দরের অবস্থাতো আরও বেহাল। এসব বন্দরে যাত্রী এবং অপেক্ষমাণদের সংখ্যা থাকে কয়েক হাজার। অপরদিকে লঞ্চে ডেক যাত্রীদের অবস্থা আরও করুণ। যারা লঞ্চে ভ্রমণ করেন তারা সবাই জানেন যে ডেকে ভ্রমণ করা হাজার হাজার মানুষকে গায়ে গায়ে মিশে চাদর বিছিয়ে ঘুমোতে হয়। যদি কোনো একজন করোনাভাইরাস সংক্রমিত লোক ওঠে তাহলে পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঢাকা-বরিশাল রুটের নিয়মিত যাত্রী ব্যবসায়ী সুলতান হোসেন বলে, ‘ঈদ-কোরবানি ছাড়াও স্বাভাবিক সময়েই ঢাকা-বরিশাল রুটে প্রায় প্রতিটি লঞ্চে ২-৩ হাজার করে যাত্রী আসা-যাওয়া করে। এসব যাত্রীর জন্য প্রতি লঞ্চে বাথরুম রয়েছে সর্বোচ্চ ১৬ থেকে ১৮টি। সিংহভাগ বাথরুম আবার থাকে প্রথম শ্রেণির যাত্রীদের জন্য। বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য এই স্বল্পসংখ্যক বাথরুমই কেবল নয়, বন্দরগুলোর পরিবেশও অস্বাস্থ্যকর। এর সবকিছুই ভাইরাস সংক্রমণের জন্য উপযোগী। নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের প্রধান বিআইডব্লিউটিএ’র উপ-পরিচালক আজমল হুদা সরকার বলে, ‘নৌ-বন্দরে করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্য বিভাগসহ অন্য কোনো বিভাগের কোনো উদ্যোগ নেই। আমরা বিআইডব্লিউটিএ’র পক্ষ থেকে সতর্কতামূলক পোস্টার ও লিফলেট বিতরণ করছি। সবাইকে সচেতন করার চেষ্টাও চলছে। সারা দেশে সরকার ঘোষিত নৌ-বন্দরের সংখ্যা ৩২টি। এছাড়া ছোটবড় মিলিয়ে ৪শ’রও বেশি ঘাটে যাত্রী ওঠানামা করে ছোটবড় লঞ্চে। সংস্থার কেন্দ্রীয় বন্দর বিভাগের পরিচালক ওয়াকিল নেওয়াজ বলে, ‘বিআইডব্লিউটএ’র নিজস্ব উদ্যোগে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা চললেও সেটা কতদূর কার্যকর তা আমরা বুঝতে পারছি না। বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষও যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হচ্ছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে তাদের পরামর্শ এবং সহযোগিতা চাওয়া হবে। আজ-কালের মধ্যেই বিষয়টি নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হওয়ার কথা। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে টিএ’র একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলে, ‘প্রকৃতপক্ষে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের (আইএসও) দেয়া একটি সতর্কবার্তা ছাড়া নৌ-বন্দর কিংবা লঞ্চ যাত্রীদের জন্য করোনা মোকাবেলায় কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি। গত ৯ মার্চ আইএসও’র পক্ষ থেকে দেয়া ১৩ পৃষ্ঠার ওই সার্কুলারে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাক্ষর করেন নৌ-পরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক কমোডর সৈয়দ আরিফুল ইসলাম। সার্কুলারটি ডিপার্টমেন্ট অব শিপিংয়ের ওয়েবসাইট ছাড়া তেমন কোথাও দেয়া হয়নি। ব্যপক প্রচারের ব্যবস্থাও ছিল না। বাংলাদেশ নৌ-যান শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি মো. শাহ আলম বলেন, ‘সবকিছু থেকে আজীবন বঞ্চিত নৌ-যান শ্রমিকদের কপালে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা আমাদের জন্য অন্যায়। তবে সরকারের উচিত ছিল বিশ্বে মহামারী হিসেবে ঘোষিত এই ভাইরাস মোকাবেলায় নৌ যাত্রী এবং শ্রমিক কর্মচারীদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া। কেননা নৌ-বন্দর এবং লঞ্চে যাত্রার মতো অধিক জনসমাগম আর কোথাও আছে বলে আমি মনে করি না। জানতে চাইলে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলে, ‘যেহেতু এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে করোনা ভয়ঙ্কর কোনো পরিস্থিতিতে যায়নি, তাই এই বিষয়টি নিয়ে আমরা এখনই ভাবছি না। এখানে এ পর্যন্ত মাত্র ৩ জন সংক্রমিত হয়েছে এবং তারা সুস্থ হয়ে বাড়ী ফিরে গেছে। তাছাড়া করোনা দেশে ঢোকার ক্ষেত্রে ঝুঁকি রয়েছে সমুদ্রপথে। সে ব্যাপারে আমরা ব্যবস্থাও নিয়েছি। অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচল করে দেশের ভেতরের মানুষ। তাদের কারও মধ্যে এখন পর্যন্ত করোনা সংক্রমণ হয়নি। আল্লাহ না করুন ব্রেক ডাউনের মতো কোনো পরিস্থিতি না হলে এখনই অভ্যন্তরীণ নৌ-পথ কিংবা নৌ-পথের যাত্রীদের নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই। তেমন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। তবে এটা ঠিক যে সবাইকে জরুরি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং সাবধান থাকতে হবে। ব্যক্তি পর্যায়ে সবার সাবধানতাই আমাদের করোনা আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে।’