স্বপ্নের পায়রা সেতুর মাধ্যমে আরও কাছে দক্ষিণাঞ্চলবাসী

দেশ জনপদ ডেস্ক | ২১:৩৯, সেপ্টেম্বর ২৬ ২০২১ মিনিট

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥  ফেরি-বিড়ম্বনা যুগের অবসান হচ্ছে সাগরকন্যাখ্যাত সৌন্দর্যের লীলাভূমি সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটা যাতায়াতের পথ। এখন শুধু অপেক্ষা পটুয়াখালী জেলার দুমকি উপজেলার লেবুখালি ইউনিয়নের পায়রা নদীর ওপর নির্মিত পায়রা সেতুর উদ্বোধনের। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী অক্টোবর মাসের যেকোনো দিন সাধারণের জন্য উন্মুক্ত হবে দক্ষিণাঞ্চলবাসীর স্বপ্নের সেতুটি। বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কে পায়রা নদীর ফেরিকে বিবেচনা করা হতো যোগাযোগের ক্ষত। সেই ক্ষত ঘোচার অপেক্ষায় এই অঞ্চলের মানুষ। এই সড়কের সর্বশেষ ফেরি বন্ধ হওয়ার মধ্য দিয়ে এক ‘উন্নয়ন বিপ্লবের’ সূচনা হবে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা। ইতোমধ্যে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা সেতুটি পরিদর্শন করেছেন। এখন চলছে রং প্রলেপের কাজ। সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ বলছে, এক দশক আগে বরিশাল থেকে কুয়াকাটা ১১১ দশমিক ৫ কিলোমিটার সড়ক অতিক্রম করতে ৭টি নদীতে ফেরি পার হতে হতো। এতে সাগরকন্যা দর্শনে বিড়ম্বনা আর সময়ক্ষয়ের অন্ত ছিল না। সব মিলিয়ে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা সময় লাগত। ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সেতু। তারপরই চালু হয় ঝালকাঠি সওজ বিভাগের আওতায় খয়রাবাদ নদীর ওপর খয়রাবাদ সেতু। ২০১৬ সালে কলাপাড়া উপজেলার আন্ধারমানিক নদীর ওপর শেখ কামাল সেতু, হাজিপুরে সোনাতলা নদীর ওপর শেখ জামাল সেতু এবং শেখ রাসেল সেতুর উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা। এরপর লাউকাঠি নদীর ওপর চালু হয় পটুয়াখালী সেতু। সর্বশেষ নির্মাণকাজ শুরু হয় লেবুখালী ইউনিয়নের পায়রা নদীর ওপর পায়রা সেতুর। বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার মো. সাইফুল হাসান বাদল বলেন, বরিশাল বিভাগীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই। কারণ, প্রধানমন্ত্রী বরিশাল বিভাগের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে যাতায়াতব্যবস্থা তৈরি করেছেন। ১ হাজার ৪৭০ মিটারের এ সেতুটি অত্যন্ত নান্দনিক ডিজাইনে নির্মাণ করা হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, এই অঞ্চলে যোগাযোগব্যবস্থার যুগান্তকারী উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমাদের যে আকাঙ্ক্ষা ২০৩০ ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ একটি দেশ তৈরি হবে, সেই লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাতে পারব। আমি সেতুটি পরিদর্শন করেছি। সেতু নির্মাণ শেষ। প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলে যেকোনো দিন সেতুটি উদ্বোধন করা হবে বলে জানান বিভাগীয় কমিশনার। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার বাহাউদ্দিন গোলাপ বলেন, সেতুটি উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলবাসী এই সরকারের উন্নয়ন বিপ্লবের যুগে প্রবেশ করবে। পায়রা সেতু দক্ষিণাঞ্চলবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্নের সেতু। এটি উদ্বোধন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি মনে করি দক্ষিণ বাংলায় যোগাযোগব্যবস্থার একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে। তিনি বলেন, যোগাযোগব্যবস্থার এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমাদের এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটার সঙ্গে যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন হবে। সেতুটি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বর্তমান সরকারের যেসব উন্নয়নের নিদর্শন রয়েছে দক্ষিণ বাংলার জন্য, পায়রা সেতু উল্লেখযোগ্য একটি নিদর্শন। বরিশাল-পটুয়াখালী বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সাবেক কাউন্টার ইনচার্জ সোহেল মোল্লা বলেন, বাস মালিক সমিতিকে কমপক্ষে ৬০০ বাস রয়েছে। কুয়াকাটা রুটের মালিকরা অনেকাংশে খেসারত দিয়ে আসছিলেন। কারণ, পায়রা নদীর ওপর চলাচলকারী ফেরিতে সময় বেশি লাগত। এখন পায়রা সেতুটি হওয়ায় যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি, পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং এই অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসবে। তিনি বলেন, পায়রা সেতুটির সাজসজ্জা ও অবকাঠামো মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। দক্ষিণাঞ্চলবাসীকে এত বড় ও সুন্দর একটি উন্নয়ন প্রকল্প উপহার দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কেমন হলো সেতুটি পায়রা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল হালিম বলেন, সড়কপথে নিরবচ্ছিন্নভাবে যেন কুয়াকাটা পৌঁছানো যায়, এ জন্য সরকারের একটি মহান উদ্যোগ পায়রা সেতু নির্মাণ। অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দনভাবে সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে। ১৪৭০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৯.৭৬ মিটার প্রস্থের সেতুটি এক্সটা ডোজ ক্যাবল স্টোরেজ পদ্ধতিতে আমরা করেছি। এই পদ্ধতিতে নির্মিত এটি দ্বিতীয়। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ চলছে। কিন্তু পদ্মা সেতুর আগেই পায়রা সেতু চালু হবে। দেশে প্রথমবারের মতো ‘ব্রিজ হেলথ মনিটরিং সিস্টেম’ চালু করা হয়েছে। এই সিস্টেম বিভিন্ন দুর্যোগ ও অভারলোড গাড়ি চলাচলের ফলে সেতুর ক্ষতি হতে পারে, এর পূর্বাভাস দেবে। তা ছাড়া কর্ণফূলী সেতুর মতো পায়রা সেতুও লং স্প্যান ব্যবহৃত হয়েছে। পায়রা সেতুতে ২০০ মিটারের স্প্যান ব্যবহৃত হয়েছে। যা পদ্মা সেতুর স্প্যানের চেয়েও বড়। বাংলাদেশের অন্য কোনো সেতুতে এত বড় স্প্যান ব্যবহৃত হয়নি। এ ছাড়া নদীর মাঝখানে একটিমাত্র পিলার ব্যবহার করা হয়েছে। ১৭ ও ১৮ নম্বর পিলারের পাইল ১৩০ মিটার দৈর্ঘ্য, যা দেশের সর্বোচ্চ গভীরতম পাইল। সেতুটি নদীর জলতল থেকে ১৮ দশমিক ৩০ মিটার উঁচু। ২০১২ সালের মে মাসে একনেকে অনুমোদন পায় পায়রা সেতু প্রকল্প। ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফোরলেন বিশিষ্ট পায়রা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে শুরু হয় সেতুর ভৌত কাজ। প্রথমে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪১৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা। তবে বিভিন্ন কারণে প্রকল্প সময় ও ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা, যা প্রকল্প শুরুর মূল ব্যয়ের প্রায় সাড়ে তিন গুণেরও বেশি। কুয়েত ফান্ড ফর আরব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট, ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ বিনিয়োগে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘লনজিয়ান রোড অ্যান্ড ব্রিজ কনস্ট্রাকশন’ সেতু নির্মাণ করেছে। মোহাম্মদ আব্দুল হালিম বলেন, সেতুটি নির্মাণের ফলে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ফেরিবিহীন নির্ঝঞ্ঝাট যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হবে।