করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে মানুষ কখন মারা যায়?

কামরুন নাহার | ১৫:৩১, মার্চ ১০ ২০২০ মিনিট

চীনের উহানে উৎপত্তি হওয়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস এখন বিশ্বজুড়ে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। এরই মধ্যে ১০৯টি দেশে ছড়িয়েছে এই ভাইরাস। রোববার (০৮ মার্চ) সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের নাম। নতুন এই ভাইরাসের প্রকোপ থেকে বাঁচতে অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে খাদ্য সামগ্রী, মাস্ক এবং স্যানিটাইজার মজুদ করছেন। তবে এই ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতনতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। করোনায় প্রাণহাণির সংখ্যা গড়ে মাত্র ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। যা প্রত্যেক বছরের মৌসুমী অন্যান্য ফ্লুবাহিত রোগের প্রাণহানির মতোই। অযথা আতঙ্কিত না হয়ে বরং একটু সচেতনতা অবলম্বন করলেই এই ভাইরাস তেমন কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। করোনাভাইরাসে বিশ্বে এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ২৭ জন মানুষ মারা গেছেন; যাদের অধিকাংশই আগে থেকে ডায়াবেটিস, কিডনি কিংবা অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত এবং বৃদ্ধ। আশার কথা হচ্ছে, করোনায় আক্রান্ত মানেই মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা সংক্রমণ একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পার হলেই কেবল সেটি প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। কী সেই পর্যায়? চলুন জেনে নেয়া যাক- গত মাসে চীন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌথ অনুসন্ধানের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নাক থেকে গলা পর্যন্ত থাকলে তাতে সর্দি, কাশি বা জ্বরের মতো সামান্য অসুস্থতা দেখা দিতে পারে। কিন্তু, সংক্রমণ ফুসফুস পর্যন্ত পৌঁছালেই বিপদ। প্রায় ৫৬ হাজার কোভিড-১৯ রোগীর অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, করোনা আক্রান্ত প্রতি সাতজনের একজন শ্বাসকষ্টসহ অন্যন্য জটিলতায় ভোগেন। ছয় শতাংশ রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে। কখনও কখনও তাদের অবস্থা সেপ্টিক শকে (রক্তচাপ কম, বিভিন্ন অঙ্গে অক্সিজেন সরবরাহে বাধা) পরিণত হয়। ডব্লিউএইচও'র সহকারী মহাপরিচালক ব্রুস এলওয়ার্ড বলেন, মৃদু বা মাঝারি সংক্রমণ খুব দ্রুত গুরুতর অবস্থায় পরিণত হতে পারে। এ ধরনের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ রোগী মারাত্মক শারীরিক জটিলতায় ভোগেন এবং ১৫ থেকে ২০ শতাংশের অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়। ষাটোর্ধ্ব বয়স এবং উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও কার্ডিওভাসকুলার রোগীদের ক্ষেত্রে করোনায় মৃত্যুঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। মেরিল্যান্ডের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসের ভাইরাল প্যাথোজেনেসিস অ্যান্ড ইভালুশন বিভাগের প্রধান জেফ্রে কে টবানবার্গার বলেন, করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তিদের হাঁচি, কাশি, কফ বা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে অন্যদের ভেতর ছড়াতে পারে। সাধারণত নাকের মধ্যে এর সংক্রমণ শুরু হয়। একবার দেহে প্রবেশ করলে এটি শ্বাসতন্ত্র রক্ষাকারী কোষগুলোকে আক্রমণ করে। তবে, সংক্রমণ ওপরে আটকে রাখা গেলে জটিলতা কমই থাকে। তিনি বলেন, ফুসফুস আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মানবদেহ ক্ষতপূরণে কাজ শুরু করে। প্রাথমিকভাবে, বিভিন্ন ধরনের শ্বেত কণিকা ক্ষতিকর জীবাণুগুলো নষ্ট করে দেয়। এই প্রক্রিয়া ঠিক থাকলে সাধারণত কয়েক দিনের মধ্যেই সংক্রমণ দূর হয়ে যায়। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস পরিচালকের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক পরামর্শক ডেভিড মোরেনস বলেন, যখন কেউ খারাপ ধরনের ও অপ্রতিরোধ্য সংক্রমণের মুখে পড়ে, তখন শরীরের সব ব্যবস্থাই এলোমেলো হয়ে যায়। একবার বিপদসীমা পার হলে সেখান থেকে সহজে ফেরত আনা যায় না। বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই বিপদসীমা পার হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি। তবে, তরুণরাও ঝুঁকিমুক্ত নয়। উদাহরণস্বরূপ, গত মাসে চীনের উহান সেন্ট্রাল হাসপাতালের চিকিৎসক লি ওয়েনলিয়াংয়ের মৃত্যুর ঘটনা টেনে আনেন আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিদ্যার অধ্যাপক স্ট্যানলি পার্লম্যান। তিনি বলেন, করোনা আক্রান্ত ৩৪ বছর বয়সী ওই চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞকে অ্যান্টিবডি, অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিবায়োটিক, অক্সিজেন, এমনকি কৃত্রিম ফুসফুসের সাহায্যও দেয়া হয়েছিল। তারপরও মারা যান ডা. লি। টবানবার্গার বলেন, কিছু লোক জিনগতভাবেই বেশি সংবেদনশীল হতে পারে। কারণ, শ্বাসতন্ত্রের যে এপিথেলিয়াল কোষগুলোতে ভাইরাস আক্রমণ করে, তাদের সেই কোষে হয়তো স্বতন্ত্র আকারের প্রোটিন রিসেপ্টর প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। তেমন, অনেকেরই রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম বা অন্যান্য কারণে সংক্রমণ বেশিও হতে পারে। গত ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহানে প্রথমবার করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এরপর দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য অঞ্চলে। এ পর্যন্ত বিশ্বের অন্তত ১১৫টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়েছে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস। এতে মৃত্যু হয়েছে ৪ হাজার ২৭ জনের, আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৪২২ জন। এর মধ্যে ৬৪ হাজার ৮১ জন সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন।