মোবাইল ফোন আসক্তি, শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় পরিবার

দেশ জনপদ ডেস্ক | ২১:০১, সেপ্টেম্বর ২১ ২০২১ মিনিট

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরগুনার পাথরঘাটা পৌরসভার ৯ নং ওয়ার্ডের তিন বছর বয়সী শিশু মো. রাফি (ছদ্মনাম)। এ বয়সে খেলাধুলা ও বাবা-মায়ের সঙ্গে খুনসুটি নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা তার। কিন্তু তার বেড়ে ওঠায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মোবাইল ফোন। ঘুম থেকে উঠেই মোবাইল ফোনে গেম খেলা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে রাফি। কার্টুন দেখা তো রয়েছেই। এমনকি তাকে খাওয়াতে গেলেও হাতে মোবাইল ফোন তুলে দিতে হয় মায়ের। একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে রাফির গায়ে হাত তুলেছেন তিনি। রাফির মা বলেন, দুই বছর বয়স থেকে রাফি মোবাইল ফোনের প্রতি আসক্ত হতে শুরু করে। খাবার খাওয়াতে গেলে কান্না করতো। কান্না থামাতে হাতে মোবাইল ফোন দিয়ে খাবার খাওয়ানো শুরু করি। এখন দেখছি মোবাইল ফোন ছাড়া তার চলে না। ওর চোখে সমস্যা শুরু হয়েছে। রাফির মতই অবস্থা পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের নিজলাঠিমারা গ্রামের আট বছরের শিশু রাইয়ানের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পরিবার জানায়, তাদের ১২ বছর বয়সী ছেলে মোবাইল ফোন কিনে দেওয়ার বায়না ধরে। বাধ্য হয়ে তাকে অ্যান্ড্রয়েড ফোন কিনে দিতে হয়। এখন ছেলে সারাদিন মোবাইল ফোনে গেম খেলা আর কার্টুন দেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। খাওয়া আর গোসল করা নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই তার। বারবার খেতে ডাকলেও না আসায় মারধরের ঘটনা ঘটেছে। গবেষকরা বলছেন, তথ্য প্রযুক্তির যুগে মোবাইল ফোনের প্রতি শিশুদের আসক্ত হওয়াটা নতুন কিছু নয়। তবে বিষয়টি কেন্দ্র করে সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে শিশুদের প্রতি পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা। শহরের পাশাপাশি প্রান্তিক এলাকার শিশুরাও ভুক্তভোগী হচ্ছে এ সহিংসতার। জানা গেছে, করোনাকালে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় শিশুদের খেলনার তালিকায় প্রথমেই ছিল বাবা কিংবা মায়ের মোবাইল ফোন। কিন্তু এখন মোবাইল ফোনের প্রতি আসক্তি শিশুদের ক্ষতি করছে। চোখের ক্ষতি, মেজাজ খিটমিটে হওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছে শিশুরা। সব মিলিয়ে তাদের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে অভিভাবকরা। সাত বছর বয়সী শিশু নিরব ও তার ছোট ভাই জিসান ঘুম থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে টিকটিক ভিডিও নিয়ে। হাতমুখ ধোয়ার আগেই মোবাইল ফোনে টিকটক ভিডিও দেখা শুরু করে তারা। তাদের মা পারভীন বেগম বলেন, নিরব ও জিসান এখন নিজেরা টিকটক ভিডিও তৈরি করছে। ওরা কি করে আমি কিছুই বুঝি না। অবস্থা এমন হয়েছে যে সকালে ঘুম থেকে উঠে মোবাইল ফোন হাতে না পেলে তাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। অবশ্য প্রান্তিক এলাকায় এ ধরনের ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। কিছু ঘটনা প্রকাশ্যে এলেও অধিকাংশ আড়ালে থেকে যায়। পাঁচ বছর ধরে মায়েদের ওপর চালানো এক জরিপে দেখা যায়, দুই বছর বয়সী শিশুরা প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১৭ ঘণ্টা, তিন বছর বয়সে ২৫ ঘণ্টা, পাঁচ বছর বয়সে ১১ ঘণ্টা মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। অতিরিক্ত স্ক্রিন ব্যবহার করায় তাদের বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। হ্রাস পাচ্ছে কর্মস্পৃহা। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুশীলনের পাথরঘাটা উপজেলা শাখার ব্যবস্থাপক ইসমাইল হোসেন  বলেন, এ বিষয়ে আমাদের জরিপ চলছে। এখন মোবাইল ফোন কেন্দ্র করেই শিশুরা পারিবারিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে। শিশুরা ভালো-মন্দ বোঝা শুরু করেনি। ছোটবেলা থেকেই তারা মোবাইল ফোনে গেম খেলতে অভ্যস্ত। কিন্তু যখন আসক্তি বেশি হচ্ছে, প্রভাব পড়ছে আচরণে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ তানভীর রহমান বলেন, মোবাইল ফোন ব্যবহারে শিশুর সুস্থ মনো-সামাজিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। সেই সঙ্গে হুমকির মুখে পড়ছে শারীরিক স্বাস্থ্য। শিশুরা এসবে আসক্ত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই অভিভাবকরা বিরক্ত হয়। কাজেই গায়ে হাত তুলছেন তারা। এই সমস্যার দেশীয় সমাধান খুঁজতে পর্যাপ্ত গবেষণার ওপর জোর দেন ঢাবির এই শিক্ষক।