চোখ জুড়ানো লাল শাপলা হারিয়ে যাচ্ছে

দেশ জনপদ ডেস্ক | ১৯:১৯, সেপ্টেম্বর ১৬ ২০২১ মিনিট

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরগুনার বেতাগী উপজেলার খাল-বিলে ফোটে বিভিন্ন প্রজাতির শাপলা। এর মধ্যে নয়নাভিরাম মনোমুগ্ধকর লাল শাপলার প্রতি আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি। বর্ষা মৌসুমের শুরুতে এ ফুল ফোটা শুরু হয়ে প্রায় চার মাস পর্যন্ত শোভা বৃদ্ধি করে চলে। বিল-ঝিল জলাশয় ও নিচু জমিতে প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয় লাল শাপলা। একসময় শাপলা মানুষের খাদ্যতালিকায় সবজি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই এলাকার বয়স্কদের কাছ থেকে জানা যায়, গ্রামের স্বল্প আয়ের মানুষরা অভাবী সংসারে এক সময় শাপলা খেয়েই পেটের ক্ষুধা নিবারণ করত। সাদা ফুল বিশিষ্ট শাপলা সবজি হিসেবে ও লাল রঙের শাপলা ঔষধি গুণে সমৃদ্ধ। ছোটদের কাছে শাপলা ফুল একটি প্রিয় খেলনার পাশাপাশি অনন্ত সৌন্দর্যের আকর্ষণ। এ এলাকার গ্রামাঞ্চলের মাঠ, জলাশয়, ডোবা-নালা, পুকুরগুলোতে বৈশাখ মাসে পানিতে ভরে যায়। এরপর তিন-চার সপ্তাহের মধ্যে এসব জলাশয় ভরে যেত সবুজ পাতা ও লাল শাপলায়। নয়নাভিরাম এসব দৃশ্য উপভোগ করত সব বয়সের মানুষ। শিশুরা এ ফুল নিয়ে খেলনায় মেতে উঠত। উপজেলার মোকামিয়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সুধীর মণ্ডল (৭৫) জানান, এ এলাকায় আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র ও আশ্বিন মাসে বিভিন্ন জলাশয়ে অগণিত শাপলা ফুল ফুটে থাকত। কিন্তু বর্তমানে আগের মতো আর লাল শাপলা ফুল দেখা যায় না। তবে প্রত্যন্ত বিলাঞ্চলে এখনো ফুটে থাকতে দেখা যায় নয়নাভিরাম লাল শাপলা। ওইসব লাল শাপলার বিলে ছুটে চলেছেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। কয়েক বছর আগেও বর্ষাকাল থেকে শরৎকালের শেষ ভাগ পর্যন্ত মাঠের যেখানে বেশি পানি, সেই এলাকায় মাইলের পর মাইল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকত নয়নাভিরাম রক্ত বর্ণের শাপলা বা লাল শাপলা। বর্ষার শুরুতে শাপলার জন্ম হলেও হেমন্তের শিশিরভেজা রোদমাখা সকালের জলাশয়ে চোখ পড়লে রঙ-বেরঙের শাপলার বাহারি রূপ দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত। এ দৃশ্য চোখে না দেখলে বোঝানো যাবে না। ওইসব লাল শাপলার সৌন্দর্য দেখতে ছুটে আসতেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। অনেকে আবার শাপলা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে। স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য হওয়ায় এ এলাকার গ্রামের লোকজন শাপলা তুলে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে এবং বিক্রি করে। উপজেলার বিবিচিনি, বাসণ্ডা, কেওড়াবুনিয়া, দেশান্তরকাঠী, ফুলতলা, গড়িয়াবুনিয়া, রানীপুর, জলিসা, ছোট মোকামিয়া, চালিতাবুনিয়া, চরখালী, মাছুয়াখালী, বদনীখালী, মায়ার হাট, চান্দখালীসহ বিভিন্ন এলাকার লোকজন বর্ষা মৌসুমে বড় বড় নৌকায় করে তাদের এলাকায় বিক্রির জন্য নিয়ে যায়। এ শাপলা শহুরে জীবনেও খাদ্যতালিকায় স্থান করে নিয়েছে। বর্তমান সভ্যতায় বাড়তি জনগণের চাপের কারণে আবাদি জমি ভরাট করে বাড়ি, পুকুর, মাছের ঘের বানানোর ফলে বদ্ধ জলাশয়ের পরিমাণ যেমন কমছে, তেমনি শাপলা জন্মানোর জায়গাও কমে আসছে। তাছাড়া জমিতে উচ্চ ফলনশীল জাতের চাষাবাদের কারণে অধিক মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন, খাল-বিল ও জলাশয় ভরাটের কারণে এ উপজেলা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে লাল শাপলা। এ বিষয় পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সন্তোষ কুমার বসু বলেন, সাধারণত শাপলা সাদা, হলুদ ও লাল তিন প্রকারের হয়ে থাকে। এর মধ্যে সাদা ফুল বিশিষ্ট শাপলা সবজি হিসেবে ও লাল রঙের শাপলা ঔষধি কাজে ব্যবহৃত হয়। শাপলা খুব পুষ্টিসমৃদ্ধ সবজি। সাধারণ শাকসবজির চেয়ে এর পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। এ ছাড়া শাপলায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম। পুষ্টি গুণাগুণ সম্পর্কে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুজন মালী বলেন, প্রতি এক শ’ গ্রাম শাপলার লতায় রয়েছে খনিজ পদার্থ ১.৩ গ্রাম, এ্যাশ ৮.৭ গ্রাম, খাদ্যপ্রাণ ১৪২ কিলো, ক্যালোরি- প্রোটিন ৩.১ গ্রাম, শর্করা ৩১.৭ গ্রাম, ক্যালশিয়াম ০.৫২ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ০.৩২, ড্রাই মেটার ৮.৪, ক্রুড আমিষ ১৬.৮, ক্রুড ফ্যাট ২.৮ ক্রুড ফাইবার ৬২.৩, নাইট্রোজেন ৩৫.৪, সোডিয়াম ১.১৯, পটাশিয়াম ২.২৩ ভাগ। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইকবাল হোসেন মজুমদার জানান, পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ শাপলা সবজি হিসেবে খেতে গ্রামের মানুষের বদ্ধ জলাশয়ে চাষ করা দরকার।