বরিশালে রপ্তানি খুড়িয়ে চললেও কাঁচামাল আমদানি বন্ধ

কামরুন নাহার | ১৮:৪৭, মার্চ ০৮ ২০২০ মিনিট

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ রপ্তানি খুড়িয়ে চললেও চায়না থেকে কাঁচামাল আমদানি করতে পারছেনা নগরীর উৎপাদনশীল শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে অর্ধ ডজন কারখানার প্রায় ৬ সহস্রাধিক শ্রমিক বেকার হওয়ার শংকা দেখা দিয়েছে। করোনা ভাইরাসের কারনে চায়না থেকে পণ্য আমাদানী থমকে গেছে বিশ্ববাজারে। পণ্যের সাথে ভাইরাস ছড়িয়ে পরার আশংকায় কোন বন্দরেই খালাস করতে পারছেনা পণ্যবাহী পরিবহন। আর এতে বাণিজ্যিক বিশ্বে চায়না একরকম কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। সুত্রে জানা গেছে, বরিশালের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে ৩/৪ অথবা দুবার বিভিন্ন কাঁচামাল চায়না থেকে আমদানি করে। বর্তমানে এ আমাদানি বন্ধ থাকায় প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে। এব্যাপারে নগরীর এ উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষ বলেন, আমরা সরাসরি আমদানি করি এখন সংকটের কারণে আমরা ঢাকার মজুতদারদের থেকে চড়া দামে কাঁচামাল কিনতে বাধ্য হচ্ছি, আর এতে উৎপাদন ব্যয় প্রায় দশগুন বেড়ে যায়। যেকারণে পণ্যের দামও বেড়ে যাচ্ছে কয়েকগুন। বরিশাল নগরীর বিসিকি শিল্প নগরী ও কসাইখানাসহ অন্যান্য এলাকায় কাঁচামাল সংকটে পড়েছে প্রায় অর্ধ ডজন উৎপাদনশীল কারখানা। মজুদ কাঁচামাল দিয়ে উৎপাদন আপাতত চলতে থাকলেও খুব শীঘ্রই উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে এমনটিই আভাস পাওয়া গেছে শিল্প প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ সুত্রে। এ ব্যাপারে বরিশাল এমইপি ইলেট্রনিক্স পণ্যের মার্কেটিং ম্যানেজার বলে, আমাদের এখানে বৈদ্যুতিক পাখা (ফ্যান), বৈদ্যুতিক ফিটিংস(সুইজ, সকেট), তারসহ প্রায় ১০/১২ ধরণের পণ্য উৎপাদন করি। আর এসকল পণ্যের জন্য সিরামিক, প্লাস্টিকের গুড়া, চীনামাটির গুড়া, মেশিন, ডাইস (সাঁচ), কেমিকেল, রংসহ প্রায় ৮ ধরণের কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। আর এসকল কাঁচামাল বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করলে সময় ও পরিবহন খরচ বেশি লাগে এছাড়া তুলনামুলকভাবে চায়নার চেয়ে দামও বেশি। আবার কিছু কাঁচামাল আছে যা চায়না ছাড়া কোন দেশ তৈরীও করেনা। যেকারণে বাধ্য হয়ে চায়না থেকেই আমদানি করতে বাধ্য হয় কারখানা মালিকরা। একইভাবে আমদানি সমস্যার কথা জানালেন ফরচুন সু হাউজের ব্যবস্থাপক মো: জাকির হোসেন। তিনি বলেন, দীর্ঘ চার মাস ধরে চায়না থেকে কাঁচামাল(প্লাস্টিক ফাইবার, বোর্ড) আমদানি করতে পারছিনা। আমরা যেসব পণ্য তৈরী করে রপ্তানি করি তাতে সমস্যা হচ্ছেনা, কিন্তু আমদানি করতে পারছিনা কারণ চায়না থেকে কোন মালামাল খালাস হচ্ছেনা এবং আন্তর্জাতিক চ্যানেলগুলোতে চায়নার কোন পরিবহন বিমান, কন্টেইনার, সড়কসহ কোন জায়গায়ই ঢুকতে দেয়া হচ্ছেনা করোনা আতংকে। এখন আমরা যা উৎপাদন করছি তা আগে যেসকল কাঁচামাল আমদানি করেছি তা দিয়ে। কিন্তু কিছুদিন চলতে পারলেও শীঘ্রই কাঁচামাল আমদানি করতে না পারলে উৎপাদন ব্যহত হবে। একই চালচিত্র তুলে ধরে পলিথিন ও পাইপ উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠান হোপ ডেভেলপমেন্ট কর্তৃপক্ষ বলে, চায়না থেকে কাঁচামাল আনার কারনে উৎপাদন নির্ভরশীলতা চায়নার উপর থেকেই যায়। করোনা ভাইরাসের কারনে পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে দেশের অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন মুখ থুবড়ে পরতে বাধ্য হবে। আর এতে বেকারত্বও বাড়বে বহুগুনে। এদিকে করোনা ভাইরাসের কারণে ভারত নির্দিষ্ট কিছু ওষুধের রপ্তানি সীমিত করায় বিশ্বব্যাপী ওষুধের অভাব দেখা দিয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম সরবরাহকারী ওষুধ প্রতিষ্ঠান জেনিরিক মেডিসিন ব্যাথা কমানো ও জ্বর সারানো সংক্রান্ত ২৬টি ওষুধ এবং ওষুধ তৈরির উপাদান রপ্তানি নিষিদ্ধ করায় এমন শঙ্কা রয়েছে। নিষিদ্ধ এই ওষুধের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম ব্যবহৃত ব্যথা উপশমকারী ওষুধ প্যারাসিটামলও রয়েছে। জানা যায়, চীনের করোনা ভাইরাসের কারণে দেশটির অনেকগুলি ড্রাগ প্রস্তুতকারক বন্ধ হয়ে গেছে। তথ্যমতে, ভারত বিশ্বের সর্ববৃহৎ ওষুধ নির্মাতা হলেও ওষুধ তৈরিতে যেসব রাসায়নিক উপাদান ব্যবহৃত হয় সেগুলোর জন্য ভারতকে চীনের ওপর ৭০ ভাগ নির্ভর করতে হয়। করোনার কারনে চীন থেকে ওষুধ তৈরিতে বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান আমদানি করতে পারছে না ভারত। একারনে ভারত থেকে বাংলাদেশও ওষুধ তৈরীতে পর্যাপ্ত কাঁচামাল সামগ্রী আসছেনা। ফলে বরিশালসহ সারাদেশে বিভিন্ন ওষুধের দাম বেড়েছে কয়েকগুন। যেকারণে শিল্প বিশেষজ্ঞরা এই ভয়াবহ মহামারির ব্যাপারে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়া চীন থেকে পণ্য আমদানি ব্যহত হওয়ায় দেশের বাজারে থাকা পোশাক শিল্পের কাঁচামালেরও দাম বেড়েছে। উদ্যোক্তাদের মধ্যে উদ্বেগ দিন দিন বাড়ছে। এককভাবে চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪৭৯ কোটি মার্কিন ডলার। বরিশাল নগরীসহ দেশের বিভিন্ন ব্যবসা ও বাণিজ্য সংগঠন তাদের আসন্ন ক্ষয়ক্ষতির জন্য তীব্র আশংকা প্রকাশ করছেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ডায়িড ইয়ার্ন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সালাউদ্দিন আলমগীর বলেন, ‘নিঃসন্দেহে করোনা ভাইরাস বর্তমান বিশ্বে এক জরুরি সমস্যা, যদিও বাংলাদেশের ডায়িং সেক্টরে প্রভাব কিছুটা কম। এর কারণ ডায়িং ফ্যাক্টরিগুলোর কাঁচামাল আমদানি একটি চলমান প্রক্রিয়া। চায়না হলিডের বিষয়টি মাথায় রেখে চাহিদা অনুযায়ী কিছু কাঁচামাল ও অন্যান্য পণ্যসামগ্রী এনেছে ব্যবসায়ীরা। আবার কিছু মালামাল প্রস্তুত আছে, তাদের ফ্যাক্টরি খোলার সঙ্গে সঙ্গেই জাহাজীকরণ সম্ভব হবে।’ এদিকে কাঁচামাল আমদানির বিকল্প উৎসও খুঁজছে ব্যবসায়ীরা। এরইমধ্যে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্ডিয়া ও নেপালকে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছে তারা। বাংলাদেশ চীন থেকে বছরে গার্মেন্টসের কাঁচামাল আমদানি করে ৫০২ কোটি মার্কিন ডলার যার মধ্যে টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস এক্সেসরিজের সরবরাহ থাকে ৪০ শতাংশের। কিন্তু বর্তমানে তাদের এই সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় বেশ কিছু কাঁচামাল ও এক্সেসরিজের দাম বেড়ে গেছে। ফলে অনেক উদ্যোক্তা তাদের এলসিকৃত পণ্য উৎপাদনে হিমসিম খাচ্ছেন এবং যথাসময়ে তারা উৎপাদিত পণ্য ডেলিভারি দিতেও ব্যর্থ হচ্ছেন। আগামী দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে চীনের পণ্য সরবরাহ প্রক্রিয়া স্বাভাবিক না হলে বরিশালসহ সারাদেশের ব্যবসায়ীগণ বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।