কাজে আসছে না কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি

দেশ জনপদ ডেস্ক | ২৩:০১, সেপ্টেম্বর ১৪ ২০২১ মিনিট

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ প্রকল্পের নাম কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতিকরণ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এর বাস্তবায়নে। বিশ^ ব্যাংক এবং বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে দেশব্যাপী এর বরাদ্দ ১১৯ কোটি টাকা। তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত, ঝড়ের পূর্বাভাস, আলোকঘণ্টাসহ ১০টি বিষয়ে তথ্য থাকে। যার মাধ্যমে কেবল কৃষক নয়; সুবিধা পাওয়ার কথা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার এবং বিমানবাহিনীর। তবে সরেজমিন বরিশাল সদর উপজেলার চন্দ্রমোহন, কাশিপুর, শায়েস্তাবাদ, রায়পাশা-কড়াপুর এবং বাবুগঞ্জ উপজেলার বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ইউনিয়নে গিয়ে কার্যক্রমের সাথে বিস্তর ফারাক পাওয়া গেছে। কথা বলে অমূলক অযুহাত মিলেছে। নিত্যদিন আবহাওয়ার পূর্বভাস আপডেটকারী উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে। গাফেলতির জন্য বিভাগীয় শাস্তির ব্যবস্থা নেয়ার কথা পর্যন্ত বললেন, উপজেলা এবং জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক পর্যন্ত। তবে আশার বাণী শোনালেন প্রকল্পের পরিচালক ড. মোঃ শাহ কামাল খান। জুন’ ২০২১-এ ২ বছর মেয়াদী প্রকল্পের কর্মসময় শেষ হলেও বর্তমান এনালগ পদ্ধতি থেকে এর ডিজিটালাইজেশনের জন্য একনেকে এর মেয়াদ ফের বৃদ্ধির অপেক্ষায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন উপজেলার ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধমে ১৬০টি আর আবহাওয়া অধিদপ্তরের অধীনে ২২৫ টি মিলিয়ে মোট ৩৮৫ টি স্বয়ংক্রিয় রেইন গজ মিটার এবং তথ্য বোর্ড রয়েছে। ২০১৮-১২ অর্থ বছরে ২ বছরের এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ১১৯ কোটি টাকা। কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আওতায় এর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষিত করা হয় মাঠপর্যায়ের উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের। তথ্য সংগ্রহের জন্য দেয়া হয়েছিল ট্যাব। এরাই কৃষকদের বা উপকূলীয় এলাকায় জেলে থেকে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠিকে গেল ৩ দিন এবং আগাম ৩ দিন মিলিয়ে ৬ দিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়ার কথা তথ্য বোর্ডের মাধ্যমে। এজন্য সদর উপজেলার ৭টি ইউনিয়ন পরিষদে ছাদে রেইন গজ মিটার এবং সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে। আর আবহাওয়ার আপডেট করার জন্য তথ্য বোর্ডটি কোথায়ওবা পরিষদ চত্বরের দর্শনীয় স্থানে, কোনটা আবার বসানো হয়েছে সচিবের কক্ষে। নিয়ম ছিল ৬ দিনের আবহাওয়ার তথ্য এই বোর্ডে আপডেট থাকবে। বাস্তবে এই বোর্ডের তথ্য কবে হালনাগাদ করা হয়েছে সে সম্পর্কে কেউ ওয়াকিবহাল নয়। কোথায়ও বোর্ড ছুটানো অবস্থায়। সংখ্যা গণনার গুটিগুলো অকেজো। চন্দ্রমোহন ইউনিয়ন পরিষদের সচিব সুবোধ চন্দ্র দাস বলেন, পরিষদ ভবনের ছাদে ড্রামাকৃতির একটি মেশিন বসানো আছে সাথে সোলার প্যানেল রয়েছে। আর তথ্য বোর্ড রয়েছে ভবনের নিচ তলায়। এর কাজ কি তিনি নিজেই জানেন না। তিনি আরো বলেন, উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের মাসিক সভায় ফোন করে আনতে হয়। এছাড়া তাদের দেখা মেলে না। এই পরিষদ ভবনের দোতালায় উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তার একটি কক্ষ রয়েছে। দুই বছরেও খোলা হয়নি বলে মেঝেতে ধুলোর পুরু স্তর জমেছে, চেয়ার টেবিলে মরচে ধরেছে। এই সচিবের দাবী আবহাওয়ার পূর্বাভাস বোর্ড হালনাগাদের জন্য তাদের নতুবা চৌকিদারদের প্রশিক্ষিত করলে এই বোর্ড নিয়মিত হালনাগাদ করতে পারতেন। আর রায়পাশা-কড়াপুর ইউনিয়নের সচিব আতিকুর রহমানের সহজ কথা, আবহাওয়ার একটি তথ্য বোর্ড আছে বটে, তবে তিনি কখনো এর কার্যক্রম দেখেননি। জুলাই মাসের ২৮ তারিখ সরেজমিন চন্দ্রমোহন ইউনিয়ন পরিষদে গেলে সেখানে কথা হয় টুমচর ৯ নং ওয়ার্ডের নাসির উদ্দিন সিকদারের সাথে। ওদিন ইউনিয়ন পরিষদে কাজ থাকায় ঘন বর্ষায় আটকা পড়েছিলেন ঘণ্টাখানেক সময় ধরে। ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের ছাদে থাকা স্বয়ংক্রিয় রেইন গজ মিটার বা নিচে থাকা আবহাওয়ার তথ্য বোর্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, আমাগো জন্য সরকারের কত কর্মসূচি অথচ কোন কার্যকারিতা নাই। আমার বাড়ি কালাবদর নদীর পাড়ে। মানুষের কাছ থেকে বা টেলিভিশনের মাধ্যমে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার খবর পাই। আর এই বোর্ডে এক সপ্তাহের আবহাওয়ার খবর দেয়ার কথা। এর কিছুই করা হয়না। এসময় পাশ থেকে একই গ্রামের মোঃ নাসির উদ্দিন নামক ব্যক্তি বলেন, আবহাওয়ার তথ্য পেলে আমাদের কৃষি কাজে বেশ উপকার হতো। কখন পানির চাপ বাড়বে, বীজতলা তলাবে কিনা বা কদিন বাদে ধান লাগালে ভালো হবে, এমন তথ্য পেলে আমাদের বেশ উপকার হতো। আর ইউনিয়ন পরিষদ জামে মসজিদের ইমাম আ. মালেক বললেন, ২ বছর হলো বোর্ড লাগিয়েছে এরপর আর হালনাগাদ করা হয়নি। এই বোর্ডে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আর মাঠ পর্যায়ের উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তার মোবাইল নম্বর দেয়ার ঘর থাকলেও তা ফাঁকা রয়েছে। এমন অবস্থা দেখা গেছে ৮ আগস্ট সদর উপজেলার কাশীপুর ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে। সেখানে তথ্য বোর্ড রয়েছে ইউনিয়ন সচিবের কক্ষে টানানো। সেখানেও কৃষি বিভাগের তিন কর্মকর্তার মোবাইল নম্বরের ঘর ফাঁকা রয়েছে। এখানের আ. খালেক চৌকিদার বলেন, তিনিতো প্রতিদিন পরিষদ খোলেন, তবে উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের সাথে দেখা হয় কম। এসময় এক যুবক এই প্রকল্পের কার্যক্রম সম্পর্কে বলেন, তিনি পোল্ট্রি মুরগির চাষ করেন। তাপমাত্রা, বাতাসের আর্দ্রতা সমেত আবহাওয়ার আগাম খবর পেলে তার জন্য বেশ হতো। এই যুবকের আক্ষেপ সরকারী প্রকল্পের টাকা তাই কে খোঁজ রাখে। বাবুগঞ্জ উপজেলার বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ইউনিয়ন পরিষদে ৯ সেপ্টেম্বর গিয়ে দেখা যায় বোর্ড টানানো আছে তথ্য হালনাগাদ হয়না বা কর্মকর্তাদের মোবাইল নম্বরের ঘর ফাঁকাই রয়েছে। ওখানের পরিষদের এক সদস্য বলেন, সদ্য নির্বাচিত হয়েছি তাই এই বোর্ডের কাজ কি তার জানা নেই। তবে ৩ সেপ্টেম্বর সদর উপজেলার শায়েস্তাবাদে গিয়ে বোর্ডে তিন কর্মকর্তারই মোবাইল নম্বর দেয়া আছে বটে, কিন্তু তথ্য হাল নাগাদের কোন নমুনা ছিল না। চলতি বছরের ২৮ জুলাই ছিল বুধবার। যথারীতি অফিস খোলা থাকার দিন। চন্দ্রমোহন ইউনিয়নের ৬, ৮ ও ৯ নং ব্লকের অন্তর্গত কৃষি আবহাওয়া তথ্য বোর্ডের দায়িত্বে থাকা উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা শাকুরুর রহিমকে ফোন করলে তিনি জানান, জেলা অফিসে আছেন। পরবর্তীতে কৃষি বিভাগের উপ পরিচালকে ফোন করলে বিকেল নাগাদ চন্দ্রমোহনে উপস্থিত হন এই শাকুরুর রহিম। তিনি বলেন, ৬ মাস হলো চন্দ্রমোহনে এসেছেন। আর এই বোর্ড অপারেটরের বিষয়ে কোন প্রশিক্ষণও পাননি। ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের দ্বিতলে থাকা তার অফিস কক্ষে ধুলোর পুরুস্তর, দামী আসবাবপত্র অব্যহৃত তাই নষ্ট হবার উপক্রম বিষয়ে তার জবাব, করোনার জন্য ঠিকমত অফিস খোলা হয়নি। এসময় একই ইউনিয়নের ৪, ৫ এবং ৭ নং ব্লকের উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলামও উপস্থিত হয়ে বলেন, আবহাওয়া তথ্য বোর্ড নষ্ট; তবে তার মোবাইল নম্বর দেয়া আছে কৃষদের গ্র“প প্রধানের কাছে। তাদের মাধ্যমে আবহাওয়ার তথ্য এবং পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আর ৮ আগস্ট কাশীপুর ইউনিয়ন পরিষদে উপস্থিত হয়ে এখানের সংশ্লিষ্ট উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. কবির হোসেনের সাথে মুঠো ফোনে কথা হলে বলেন, তিনি দূরে আছেন। তাদের রেইন গজ মিটারে কোন কাজ করেনা বলে আবহাওয়া বোর্ডের তথ্য আপডেট করা যায়না। বৈশি^ক জলবায়ু পরিবর্তনের এই সময়ে এটি সময় উপযোগি প্রকল্প বলে অভিহিত করলেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোসাঃ ফাহিমা হক। এই প্রকল্পের মাধ্যমে উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে কিভাবে এর রিডিং নেবেন এবং বোর্ডের চাকা ঘুরিয়ে আবহাওয়ার তথ্য হালনাগাদ করবেন। এজন্য প্রত্যেককে ট্যাব দেয়া হয়েছে। এখান থেকে আবহাওয়ার তথ্য পেয়ে কৃষকরা মাঠে থাকা ধান কখন কাটবেন বা সামনে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া থাকলে ধান আগাম কাটতে হবে কিনা, সে বিষয়ে জানতে পেয়ে উপকৃত হবেন। তবে তাদের রেইন গজ মিটার বা তথ্য বোর্ড কোথায়ও খারাপ হলে প্রকল্পের টেকনিশিয়ানদের বললে তারা এসে সেরে দেয় কখনোবা। তিনি বলেন, এই কাজে গাফিলতি করা হলে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ নিয়ে কৃষি অধিদপ্তরের উপ পরিচালক হৃদয়েশ^র দত্ত’র বক্তব্য হলো, এখানে টেকনিক্যাল বিষয় জড়িত বলে তারা মৌসুমি ভিত্তিক চাষী এবং উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেন এই পদ্ধতি নিয়ে। যাতে করে বৃষ্টি মাপা, দৈনন্দিন আবহাওয়া নিরূপন করা সহজীকরণ করে অতি দ্রুত নিউজ পেতে পারে। এজন্য উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের মোবাইল নম্বর চাষীদের কাছে দেয়া হয়। তবে কৃষি আবহাওয়া বোর্ডে ঘর থাকলেও উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা বা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার মোবাইল নম্বর না থাকার বিষয়ে বলেন, আপনার (এই প্রতিবেদকের) মাধ্যমে জানলাম, অতিদ্রুত মোবাইল নম্বর দেয়া, দৃশ্যমান স্থানে আবহাওয়া বোর্ড টানানো এবং এর তথ্য হালনাগাদ করার ব্যবস্থা নিবেন তিনি। এছাড়াও প্রতি উপজেলায় কিয়স্ক বক্স দেয়া হয়েছে, সেখান থেকেও কৃষকদের আবহাওয়ার তথ্য দেয়া হয়। এবিষয়ে গাফেলতি হলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার ন্যায় জেলার এই কর্মকর্তাও বলেন বিভাগীয় ব্যবস্থা নেবেন সংশ্লিষ্ট উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এই কর্মকর্তার দেয়া হিসেবে জেলায় ৫৮টি ইউনিয়ন বা ব্লকে রেইন গজ এবং তথ্য বোর্ড থাকলেও সচল রয়েছে মাত্র ১৯টি। এই প্রকল্পের পরিচালক ড. মো. শাহ কামাল বলেন শুরুতে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের ১১৯ কোটি টাকার বরাদ্দ ছিল। যার মেয়াদ জুন’২১ শেষ হয়েছে। এখন এসব যন্ত্রপাতি আধুনিকায়ন করে সামনে আরো ২ বছর মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য ৯৪ কোটি টাকার বর্ধিত প্রকল্প একনেকে পাশের অপেক্ষায়। এতে করে কৃষিকাজ, আবহাওয়া অদিদপ্তরের পাশাপশি পানি উন্নয়ন বোর্ড, সেনাবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর কাজের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।